bishwa istama

দৈনিকবার্তা-টঙ্গী, ১০ জানুয়ারি ২০১৬: আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন, ছুম্মা আমিন ধ্বনিতে অনুতপ্ত মানুষের কান্নার আওয়াজে রবিবার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে ইজতেমা ময়দান। জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করে পানাহ ভিক্ষা করছিলেন তাঁরা। ইহলোকের মঙ্গল, পরলোকের ক্ষমা, দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনা করে আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে রবিবার। মোনাজাত শুরু হতেই পুরো এলাকা জুড়ে নেমে আসে পিন পতন নীরবতা। বেলা ১১টা ৭ মিনিট থেকে মোনাজাত শুরু হয় এবং তা চলে ২৫ মিনিট, অর্থাৎ বেলা ১১টা ৩২ মিনিট পর্যন্ত। বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি ভারতের মাওলানা সা’দ আহমেদ আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করেন। প্রথম পর্বের পর চারদিন বিরতি দিয়ে আগামী ১৫ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে শুরু হবে দ্বিতীয় পর্বের ৩ দিনব্যাপী বিশ্ব এজতেমা।

মোনাজাতে অংশ নিয়ে ক্ষমা লাভের আশায় লাখো মানুষের সঙ্গে একত্রে হাত তুলতে শীত ও কুয়াশাকে উপেক্ষা করে দূরদূরান্ত থেকে লাখ লাখ মুসল্লী টঙ্গীর তুরাগ পাড়ের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ছুটে এসেছিলেন রবিবার ভোর থেকেই। বহু মানুষের অংশগ্রহণে আজকের প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে সংশি¬ষ্ট সূত্রের ধারণা।রবিবার আখেরী মোনাজাতের দিন বাদ ফজর থেকে খাস বয়ান করেন বাংলাদেশ তাবলিগের মজলিসে শূরার সদস্য মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম। এরপর থেকে মোনাজাতের আগ পর্যন্ত ভারতের মাওলানা সা’দ আহমেদ তাবলিগের গুরুত্ব তুলে ধরে মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে হেদায়তি বয়ান করেন। তা বাংলায় তরজমা করেন তাবলিগের মুরুব্বী ও কাকরাইল মসজিদের ঈমাম হাফেজ মাওলানা জোবায়ের। এসময় ইজতেমাস্থলে আগতরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সেসব বয়ান শুনেন।

হেদায়তী বয়ানে ভারতের মাওলানা সা’দ বলেন, ইসলামে নামাজের স্থান মানুষের দেহের মাথার মতো। নামাজ হলো আল্লাহর হুকুম। আল্লাহর হুকুম পুরা হলে তার ওয়াদা পূরণ হয়ে যায়। যার দীলে আল্লাহর এক্কিন পয়দা হবে, সে আল্লাহর হুকুমকে অগ্রাধিকার দেবে। নামাজের ফজিলত বান্দা তখনই পাবে, যখন কেউ রাসুল (সা.) এর মতো করে নামাজ পড়ে। ভালো মউত তাদেরই হবে, যারা আল্লাহর হুকুম ও রাসুল (সা.)-এর হুকুমমতো চলে। দ্বীনের ঘরে বসে ইবাদতের চেয়ে বাইরে মেহনত করে ইবাদত বন্দিগী করা অনেক ফজিলত। আল্লাহ তার বান্দাদের দ্বীনের কাজে রাস্তায় বের হতে হুকুম দিয়েছেন। সকলকে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার কথা বলেছেন। আর এ দাওয়াতের জন্য তালিম নিতে হবে। মহল্লায় মহল্লায় মসজিদে বসে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে পরামর্শ করতে হবে। এতে শত্রুও বন্ধু হয়েে যেতে পারে। যিনি এখলাছের সাথে দ্বীনের কাজ করবেন তিনিই কামিয়াব হবেন। আল্লাহকে খুশি করার জন্য কাজ করলে জীবনে সফলতা আসে। সবচে বড় আমল হলো দ্বীনের কাজে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া।

ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, জর্ডান, তুরস্ক, লেবানন, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্ততঃ ৯৫টি দেশের তাবলিগ জামাতের প্রায় ১০ হাজার বিদেশি মেহমান এবারের ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সর্বোচ্চ সংখ্যক বিদেশি মেহমান আগমন করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তাবলিগের কাজে বের হওয়ার জন্য এবার ইজতেমা স্থলে প্রথম পর্বে প্রায় ৬ হাজার জামাত তৈরি হয়েছে বলে ইজতেমার আয়োজক সূত্রে জানাগেছে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে জানিয়েছে তাবলিগ সূত্র ।

বিশ্ব ইজতেমার মূল আকর্ষণ হচ্ছে আখেরি মোনাজাত। প্রতিবারের মতো এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান মন্ত্রীসহ মন্ত্রী পরিষদের বিভিন্ন সদস্যবর্গ, সাংসদসহ বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গ অংশ গ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বঙ্গভবনে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুলশানে নিজের কার্যালয়ে টেলিভিশনের সামনে বসে সরাসরি সম্প্রচার দেখে মোনাজাতে অংশ নেন। এদিকে বিশ্ব ইজতেমায় আগত লাখো লাখো মুসল্লির সঙ্গে ইজতেমা ময়দানের জেলা পুলিশ প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমে বসে আখেরী মোনাজাতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ, জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, স্বরাষ্ট্র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান, অতিরিক্ত ডিআইজি সফিকুল ইসলাম, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম আলম ও পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ, জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান।

এছাড়াও আখেরী মোনাজাতে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের কূটনীতিক বৃন্দ, বিভিন্ন রাজনেতিক দলের নেতৃবর্গ শরিক হন। এ ছাড়া পদস্থ সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তাসহ দল-মত, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমান আখেরী মোনাজাতে অংশ নেন।এদিকে মোনাজাত অনুষ্ঠানের পর রবিবার দুপুরে ইজতেমা ময়দানে জামাতবদ্ধ এক মুসল্লী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার নাম হাফেজ আবু বকর (৬০)। তার বাড়ি চট্রগ্রামের হাটহাজারী থানার আলীপুর গ্রামে। এনিয়ে এক বিদেশীসহ ৯ জন মারা গেছেন।

মুসল্লীদের অংশ গ্রহন বেড়ে যাওয়ায় মুসুল্লীদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় এবং দূর্ভোগ লাঘবের লক্ষে ২০১১ইং সাল থেকে দুই পর্বের ইজতেমা শুরু হয়। এরপর একই কারনে প্রথমবারের মতো এবছর হতে (২০১৬ইং) চার ভাগে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। দেশের মোট ৩২টি জেলা নিয়ে এবছর (২০১৬ইং) ইজতেমার দুই পর্ব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পরবর্তী বছরে (২০১৭ সালে) বিশ্ব ইজতেমার দু’পর্বে বাকী ৩২ জেলার মুসল্লীরা অংশ নিবে। এবছরের প্রথম পর্বে অংশ নেয় ঢাকার একাংশসহ ১৭টি জেলার তাবলিগ অনুসারীরা। দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেবে ১৫টি জেলাসহ ঢাকার বাকী অংশের তাবলিগ অনুসারীরা। তবে বিদেশী মুসল্লীরা প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে পারবে। উল্লেখ্য ১৯৯৬ সালে একই বছর দুইবার বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইজতেমার আয়োজকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯১০সালে ভারতের মাওলানা ইলিয়াস (রাঃ) তাবলীগ জামাতের প্রচলন শুরু করেন মাওয়াত এলাকা থেকে।