দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৮ জুন: চলতি বছরের নভেম্বর মাসের পরে স্থল সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সব বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাংলাদেশ সীমান্তের পুরোটাই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলবে ভারত। দেশটির বিদেশ মন্ত্রকের অফিসাররা এমনটাই জানিয়েছেন।বৃহস্পতিবার কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।সীমান্ত-বিবাদ অতীত হচ্ছে, আশায় দুই দেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে স্থলসীমা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এসেছেন। এর পরে ছিটমহলগুলি হস্তান্তরের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন হবে। সেই কাজে সমন্বয়ের জন্য মঙ্গলবার কলকাতায় বৈঠকে বসেছিলেন ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা।
ভূখণ্ড হস্তান্তরের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাসিন্দাদের পুনর্বাসন পর্ব শেষ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এই বৈঠকে।বাংলাদেশের এক অফিসারের কথায়— নভেম্বরের পরে স্থলসীমান্ত নিয়ে আর কোনও বিভ্রান্তি ও মন কষাকষি থাকছে না দু’দেশের মধ্যে। আর ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের অফিসারেরা জানাচ্ছেন, এই বিবাদের অবসান ঘটানোর পর বাংলাদেশ সীমান্তের পুরোটাই কাঁটাতারের বেড়ায় বাঁধতে চায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, যাতে অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান স্থায়ী ভাবে বন্ধ করা যায়।ঢাকায় চুক্তি স্বাক্ষরের পরে দুই বিদেশসচিবের বৈঠকে ছিটমহল হস্তান্তরের একটি সম্ভাব্য দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তাতে ঠিক হয়েছে জমি হাত বদলের কাজ শেষ করা হবে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে। ভারত ও বাংলাদেশের অফিসারদের নিয়ে গড়া জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্র“প (জেবিডব্লুউজি) তার আগে ওই এলাকা পরিদর্শন করবেন। ছিটমহলের অধিবাসীরা কে কোন দেশের নাগরিকত্ব চান, সে বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে একটি সমীক্ষাও করা হবে। তার পরে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ছিটমহলের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের কাজ শেষ করা হবে। এই কাজের জন্য ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র।
তবে ছিটমহলের বাইরেও বেশ কিছু জমি হস্তান্তর করবে দুই দেশ।একে অ্যাডভার্স পজেশন বলা হচ্ছে। দু’দেশের জমির দলিল ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, ছিটমহল ছাড়াও ভারতের ভূখণ্ডের ভিতরে বাংলাদেশের বেশ কিছু জমি রয়েছে। সীমান্ত লাগোয়া এই সব জমির বেশির ভাগেই চাষবাস হয়। একই ভাবে বাংলাদেশের চৌহদ্দির মধ্যে অনেক জমি আদতে ভারতের। ছিটমহল হাত বদলের পাশাপাশি ওই জমিও হস্তান্তর হবে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকবে ২৩৯৮ একর জমি। আর ভারত থেকে বাংলাদেশে যাবে ১৯৫৮ একর জমি। মালদহ, নদীয়া এবং জলপাইগুড়ি জেলার সীমান্ত এলাকায় এই জমি বিনিময় হবে। বিদেশসচিব স্তরের বোঝাপড়ায় ঠিক হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে সীমান্ত নিয়ে কোনও বিভ্রান্তি দেখা দিলে আলোচনায় বসে তারও সমাধান করবে জেবিডব্লিউজি।
ছিটমহল বিনিময়ের পর ভারতে যুক্ত হবে ৭৭১০ একর জমি। ১৭১৬০ একর জমি পাবে বাংলাদেশ। প্রাথমিক সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে ভারতে যে ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল যুক্ত হচ্ছে, তার প্রায় সব বাসিন্দাই ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থাকতে চান। অন্য দিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল মিশছে, তার বাসিন্দাদের একটা ছোট অংশ ভারতে থেকে যাওয়ার অপশন দিতে পারেন। বিদেশ মন্ত্রকের অফিসারেরা জানিয়েছেন, দু’টি ক্ষেত্রেই সেই সব মানুষের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দেওয়া হবে।
৩০ নভেম্বরের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে বিদেশসচিব স্তরের ওই প্রস্তাবনায়। বাংলাদেশে মিশে যাওয়া ভারতীয় ছিটমহলগুলির যে সব বাসিন্দা তাঁদের পুরনো বসবাস ছেড়ে ভারতে আসার অপশন দেবেন, তাঁদের আসার জন্য মেখলিগঞ্জ, হলদিবাড়ি ও ফুলবাড়ি সীমান্তের এই তিনটি জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। গত ৬ জুন যৌথ ঘোষণায় অর্থনৈতিকভাবে দুটি দেশের এগিয়ে চলায় পারস্পরিক সহযোগিতার কথা বললেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুজনই বললেন, বাণিজ্য, নৌ, বাস চলাচলসহ যেসব চুক্তি হয়েছে, তা শুধু দুটি দেশেরই নয় আঞ্চলিক যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ৬৮ বছরের স্থল সীমান্ত সমস্যা সমাধানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বলিষ্ঠ ভূমিকার প্রশংসা করেন। শনিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা জানান, দুদেশের মধ্যে ৭টি যৌথ প্রকল্পের ফলক উন্মোচন, ২২টি চুক্তি ও এমওইউ সই হয়েছে। বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে ভারত।
গত ৬ জুন প্রথম সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় আসার পর বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এসব চুক্তি সই হয়।চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে- দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি (নবায়ন), উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা ও ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস চলাচলে চুক্তি ও প্রটোকল এবং অভ্যন্তরীণ নৌ ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকল (নবায়ন)।সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভারত-বাংলাদেশের কোস্টগার্ডের সহযোগিতা, মানবপাচার রোধবিষয়ক, পাচার ও জাল নোটের বিস্তার প্রতিরোধ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সার্কের জন্য ভারতের অনুদান ও সাংস্কৃতিক বিনিময়শনিবার বিকালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের শাপলা কক্ষে ভারতের হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর এবং বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরাসহ দুদেশের কর্মকর্তারা এসব চুক্তিতে সই করেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯ চুক্তি, সমঝোতা ও সম্মতি স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। শনিবার বিকেল সাড়ে ৬টার দিকে এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।এর আগে, একই হলে হলে একযোগে সাত প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।দু’টি রেলপথ, একটি সেতু, সীমান্তহাট, সারদায় মৈত্রীভবন ও বিএসটিআই’র জন্য একটি টেস্টিং ল্যাব তৈরির এসব প্রকল্প যৌথভাবে বাস্তবায়িত হবে।শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা ২০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে এই প্রকল্পগুলোর ফলক উন্মোচন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী।প্রকল্পগুলো হচ্ছে- খুলনা-মংলা পোর্ট রেলওয়ে লাইন, কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলওয়ে লাইন, ফেনী নদীর উপর বাংলাদেশ-ভারত প্রথম মৈত্রী সেতু, শিলাইদহে রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির সম্প্রসারিত উন্নয়ন কার্যক্রম, তারাপুর-কমলাসাগর সীমান্ত হাট, সারদা পুলিশ লাইনে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী ভবন ও বিএসটিআই’র উন্নত মানের টেস্টিং ল্যাব।