দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি: দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে নিজ উদ্যোগে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে কোনো প্রস্তাব নিয়ে যাবে না অরাজনৈতিক কমিটি। কেউ যদি তাদেরকে চান তা হলেই তারা যাবে না। শংকা প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলনে আর বলা হয়, সমস্যার সমাধান না হলে, বিকল্প নেতিবাচক শক্তির উত্থান ঘটতে পারে।সহিংসতা বন্ধ করে সংলাপের পরিবেশ তৈরি করতে হবে আর তা করতে হবে সমান্তরালভাবে বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ড. এটিএম শামসুল হুদা।
শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটির শীর্ষ নেতা শামসুল হুদা এ কথা জানান।প্রসঙ্গত: দেশের চলমান সঙ্কট নিরসন ও জাতির কাছে তার সমাধান তুলে ধনার জন্য অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা এর নেতৃত্বে রয়েছেন।শামসুল হুদা বলেন, শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে। এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করে কিভাবে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায় সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। আমরা চাই, অবিলম্বে সন্ত্রাস বন্ধ এবং আলোচনা করতে হবে।
নবগঠিত কমিটির কোন নাম দেয়া না হলেও টিকে একটি অরাজনৈতিক নাগরিক সমাজ বলা যেতে পারে বলে তিনি জানান।এ কমিটির মধ্যে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি থাকবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে যারা আছেন এবং আসবেন তারা কেউ সরাসরি রজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। অনেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কেউ দেশে এবং কেউ দেশের বাহিরে আছেন। যাছাই বাছাই করে এ কমিটি আরো বড় করা হতে পারে।
তিনি বলেন, দেশে আজ এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থা থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংকট উত্তরণের মাধ্যমে জনগণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে আগ্রহী। জনগণ চায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ-যাতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি লক্ষমাত্রার দিকে দেশে এগুতে পারে এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা যথাযথভাবে প্রস্তুত ও বাস্তবায়ন করে ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রা- বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার উদ্যোগ সফল হতে পারে। তাই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরাও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এসময় তিনি দুই দলকে সংঘাত ছেড়ে সংলাপের আহ্বান জানান।এর আগে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনকে চিঠি দিয়ে সংলাপের আহ্বান জানালে সরকারীদল আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে নাগরিক সমাজ ও বার্তা প্রেরক শামসুল হুদা। জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন,তাদের প্রস্তাবের মানে নাশকতা,সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদীদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সরকার ও একটি গণতান্ত্রিক দলকে এক কাতারে দাঁড় করানো। তাদের প্রস্তাব অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য।
কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে হুদা বলেন, পরিস্থিতি নিরসনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আহ্বান জানানো। আমরা শান্তির পক্ষে। সাধারণ নাগরিকদের পক্ষে কথা বলবো। তবে কমিটি স্ব উদ্যোগে কোন দল বা নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করবে না। তিনি বলেন, আমাদের যদি কেউ ডাকে তাহলে আমরা যাবো।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করতে পারি। আমরা কেন আমাদের সমস্যা সমাধান করতে পারবো না? বিদেশীরা আসা কাম্য না। রাজনীতির মধ্যে শেষ বলতে কিছুই নেই। আমরা পারবো।অরাজনৈতিক নাগরিক সমাজের প্রাথমিক কমিটিতে ২১ জনকে সদস্য করা হয়েছে। তবে এর সংখ্যা আরো বাড়বে বলে জানান এটিএম শামসুল হুদা।
সংবাদ সম্মেলন শেষে গঠিত কমিটির একটি খসড়া পাওয়া গেছে। ওই খসড়ায় যাদের নাম রয়েছে তারা হচ্ছেন- সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এটিএম শামসুল হুদা, এম হাফিজ উদ্দিন খান, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এসএম শাহজাহান, শিক্ষাবিদ ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান, সিএম শফী সামী, সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি রোকেয়া আফজাল রহমান, বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, মাহবুবুর রহমান, আইনজীবী শাহদীন মালিক, মাহফুজ আনাম, অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম, বিজিএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ,বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
মূলত গত শনিবার ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার কক্ষে জাতীয় সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপ শীর্ষক আলোচনা সভার মধ্যদিয়ে আলোচনায় আসে নাগরিক সমাজ। সভাটির আলাদা দুই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান ও এটিএম শামসুল হুদা।সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন- আইনজীবী শাহদীন মালিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক সিএম শফী সামী, সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান প্রমুখ।
দেশে চলমান অবস্থাকে রাজনৈতিক সংকট হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, সহিংসতা কোনো আন্দোলনের পথ নয়, সহিংসতা বন্ধ করে আলোচনা বা সংলাপের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তা করতে হবে সমান্তরালভাবে।শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রীতি ও সংলাপের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা বলে সংলাপের কোনো প্রয়োজন নেই, বর্তমান অচলবস্থার নিরসনের পন্থা তাদেরকেই বের করতে হবে।শামসুল হুদা বলেন, আমরা সংবিধানের মূলনীতির প্রতি বিশ্বাস ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের এ উদ্যোগ, নাগরিকদের পক্ষে।প্রথমে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা থাকলেও এবার তাদের রাখা হয়নি নিরপেক্ষতার স্বার্থে।
তিনি আরো জানান, রাজনীতিবিদরা মুখে অনেক কথাই বলেন। তবে কাজ করেন ভিন্ন রকম।অপর এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, রাষ্ট্রপতি বা দুই নেত্রী বা দলের নেতাদের সঙ্গে তারা কোনো রকম দুতয়ালি বৈঠক করবেন না।
সংবাদ সম্মেলনে উদ্বিগ্ন নাগরিকদের পক্ষে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৫ উপদেষ্টাসহ মোট ১৩ সদস্যের একটি কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়। যদিও কমিটিভুক্ত মাত্র ৫ জন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।এর আগেও গোলটেবিল আলোচনায় সংলাপের প্রস্তাব গ্রহণ করে এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বরাবর চিঠি পাঠায় নাগরিক সমাজ।সন্ত্রাস দমন ও সংলাপ সমান্তরালভাবে চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন নাগরিক সমাজর আহ্বায়ক ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এটিএম শামসুল হুদা। তিনি বলেছেন, দেশের মধ্যে আগুন লেগে গেছে। এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, একদিকে সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে, অপরদিকে সংলাপ এগিয়ে নিতে হবে। সবার মধ্যে আস্থার জায়গা সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে দেশের সমস্যা সমাধান করা যাবে না।নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি শামসুল হুদা বলেন, আলোচনা শুরু করতে হবে। এরপর আমরা নিজেদের অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখবো। আমাদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নেই। আমরা নিজ গন্ডির মধ্যে কাজ করি, কেউ সরকারি চাকরি করেছি, কেউ আবার ব্যবসায়ী। আমরা নিজেরা কাজ করতে চাই না। এটা রাজনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আসলে আমরা অবদান রাখতে পারবো। আমরা পেশাজীবীরা দেশের সহিংসতা বন্ধে কাজ করতে চাই।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতের সঙ্গে সরকার সংলাপ করবে কিনা এটা সরকারের বিষয়। কমিটির কাজ হচ্ছে দেশে কী হচ্ছে- কী হতে যাচ্ছে সেই বিষয়ে পর্যবেক্ষণে রাখা। আমরা আমাদের কথা সবার মধ্যে জানান দিলাম। আমরা টেকসই সমাধান চাই।শামসুল হুদা বলেন, আমাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আছে, দেশের সংকট উত্তরণে সেটা কাজে লাগাতে চাই। আমরা রাজনৈতিক দলসহ ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হবো। দেশের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
আগে সংলাপ হবে না সহিংসতা বন্ধ হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে সহিংসতা বন্ধ হতে হবে এবং দেশের মধ্যে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবে সংলাপের আশ্বাসও দিতে হবে।দেশের সমস্যা নিরসনে বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে শামসুল হুদা বলেন, আমাদের সমস্যা আমাদেরেই সমাধান করতে হবে। বিদেশিদের হস্তক্ষেপ ভালো দেখায় না।
এর আগে লিখিত বক্তব্যে শামসুল হুদা বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা একটি গোলটেবিল বৈঠকে মিলিত হয়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছি। দেশে আজ এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থা থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংকট উত্তরণের মাধ্যমে জনগণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আগ্রহী।তিনি বলেন, জনগণ চায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ- যেন অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষ্যমাত্রার দিকে দেশ এগোতে পারে এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যথাযথভাবে প্রস্তুত ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে।
লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরাজমান সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে। যেন নারী-শিশু, মাতা-পিতাসহ সকল নির্দোষ মানুষ অস্বাভাবিক মৃত্যু ও জ্বালানো-পোড়ানোর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও ব্যবস্থা সুষ্ঠ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।তিনি বলেন, দেশের আমদানি রফতানি, শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম চালিকাশক্তি স্বাভাবিক পরিবহন ব্যবস্থা অপরিহার্য, এ খাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।সিইসি আরও বলেন, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা আমাদের জাতীয় অর্থনীতি ও জনজীবনকে বিপযর্য়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যার মূল কারণ হচ্ছে- সরকার ও তাদের প্রতিপক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে যে কোনো রাজনৈতিক বিরোধ বা সংকট নিরসনের শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক রীতি হচ্ছে সংলাপ।