নতুন দেশ গড়ার প্রত্যয়ে বছর ঘুরে ফের এলো পয়লা বৈশাখ, বাংলা বছরের প্রথম দিন। ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ ভোরের আলো ফোটার সাথে যাত্রা শুরু করবে বাংলা নতুন বর্ষ ১৪৩২। এর আগে গতকাল চৈত্রের শেষ সূর্য ডুবার সাথে বর্ষ পঞ্জিকার সাথে বিদায় নেয় ১৪৩১ সন। বাংলা বর্ষবরণে সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে বের হবে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। এতে পুরাতন মুছে দিয়ে আগামীর কল্যাণ কামনায় নতুন সূর্যকে বরণ করবে গোটা জাতি। পুরনো হিসাব-নিকাশ শেষ করে নতুন ‘হালখাতা’ উন্মোচন করবেন ব্যবসায়ীরা।
অন্যান্য বছরের চেয়ে এবারের পয়লা বৈশাখ এসেছে ভিন্ন রূপে। ফলশ্রুতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিজয়ের আবহে আজ উৎসবে মেতে উঠবে দেশবাসী। সেই সাথে ফ্যাসিসের বিদায়ে আনন্দ আর শুভেচ্ছা বার্তায় থাকছে ভবিষ্যতের নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন।
সকাল থেকেই বর্ণিল উৎসবে সাজবে দেশ। রাজধানীসহ দেশজুড়ে শুরু হবে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করবে বাংলা নববর্ষকে। নতুন দিনের সূর্য উঁকি দেয়ার সাথে ‘এসো হে বৈশাখ’ গান পরিবেশনের মাধ্যমে বৈশাখ বরণ শুরু হবে।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ আনন্দ উৎসবটি একসময় আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে যায় এবং বাংলার চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি এখনো পালিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য বছরের মতো এবারো দেশে নানান আয়োজনে পালিত হবে দিনটি।
বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। বছরের প্রথম দিনটি বাঙালিরই শুধু নয়, বাংলা ভাষী আদিবাসী ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জীবন-জগতে স্বপ্নময় নতুন বছরের শুভ সূচনা ঘটায়। জীর্ণ-পুরনোকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করে বাঙালি জাতি।
এ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ সেজেছে নতুন সাজে, নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। বাঙালি জাতির শাশ্বত ঐতিহ্যের প্রতীক এ দিনটি উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষ এবং চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা এবং গারোসহ অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপনের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উৎসব আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। দিনটিকে আরো উৎসবমুখর করতে আয়োজন করা হয়েছে শোভাযাত্রা ও বৈশাখী মেলা। যাতে প্রদর্শিত হবে কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী, খেলনা এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারোহ। থাকবে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, যাত্রা, লোকজ গানের আসরসহ নানান বিচিত্র বিনোদন। সরকারের নেয়া কর্মসূচি অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, মহানগর ও পৌরসভা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তিন পার্বত্য জেলা এবং অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক দলগুলোর শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের সমন্বয় করবে। পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে ভোরে রমনা বটমূলে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ছায়ানট। বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং বাংলাদেশ লোকশিল্প ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন বৈশাখী মেলার আয়োজন করেছে।
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের জন্য বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেইসাথে, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ির জাতিগত গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো একইসাথে বৈসাবি উৎসব উদযাপন করবে। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে সব জাদুঘর এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য এদিন লাগবে না কোনো টিকিট।
উৎসবমুখর পরিবেশে ঢাবি ক্যাম্পাসে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ বের করবে। নতুন বর্ষবরণ উপলক্ষে দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব চলবে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
এ ছাড়া সরকারের নেয়া কর্মসূচি অনুসারে, বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের পরিবর্তে সংবাদপত্রগুলোতে পয়লা বৈশাখের তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ ফিচার প্রকাশ করা হয়েছে। দিনটি উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলসহ অন্যান্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো অনুষ্ঠান সম্প্রচার ও চিত্রিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সব সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন, বাণিজ্যিক রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিওতে শোভাযাত্রা সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছে।
ঋতুর ওপর নির্ভরশীল কৃষিকাজ, আর কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল খাজনা আদায়। কৃষিনির্ভর বাংলার মানুষের সুবিধার্থে মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন। হিজরি চান্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত নতুন সনটিই একসময় ‘বঙ্গাব্দ’ নামে পরিচিত হয়।
বহু আগে থেকেই বাংলার কৃষক ও গৃহস্থরা চৈত্র মাসের শেষদিন ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ পালন করতেন। কৃষকরা এদিন ভূস্বামীদের হাতে বাকি থাকা সকল খাজনা তুলে দিতেন, আর ব্যবসায়ীরা পুরনো বছরের সব লেনদেনের হিসাব চুকিয়ে নতুন বছর উপলক্ষে খুলতেন লালসালু মোড়ানো নতুন হালখাতা, যা এখনো ধরে রেখেছেন বাংলার অনেক ব্যবসায়ী।
মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে। পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সাথে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সাথে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এ সময় ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আরো গৌরব আর অহংকারের সাথে উদ্ভাসিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটর লুইস সেপুলভেদা গত ১৫ জানুয়ারি সিনেটে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন ১৪ এপ্রিলকে নিউইয়র্কে বাংলা নববর্ষের স্বীকৃতি দিতে। ২৩৪ নম্বরের এই রেজ্যুলেশন ২২ জানুয়ারি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে বাঙালির জন্য গৌরবের।