অতীতে গ্রাম-বাংলার হাট বাজার, বড় বড় বৃক্ষের ছায়ায় বসে. চুল দাঁড়ি কাটার কাজ করতেন নাপিত বা নরসুন্দর সম্প্রদায়। নাপিতরা একটি কাঠের বাক্সে তাদের যন্ত্রপাতি রাখতেন। যার মধ্যে ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি, সাবান, ফিটকারি, পাউডার থাকতো। হাট বাজারের নিদিষ্ট স্থানে লাইন ধরে পিঁড়িতে বসতেন এই নরসুন্দররা। সম্মুখে থাকতো গ্রাহকের জন্য অপর একটি বসার পিঁড়ি।
গলায় সাদা কাপড় পেঁচিয়ে নিজেদের দুই হাঁটুর মাঝে গ্রাহকের মাথা ঢুকিয়ে চুল কাটতো। সে সময়ের মালই ছাট ,নাইড়া , দিলিপ ছাট, হাপ ছাট, গোল ছাট, টেডিছাট চুল কাটার নাম বর্তমান প্রজন্ম অজ্ঞাত। এভাবে পিঁড়িতে বসিয়ে গ্রামবাংলার মানুষের চুল-দাড়ি কাটার সেই পরিচিত দৃশ্য এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না। তাছাড়াও প্রতিটি গ্রামের পাড়ায় মহল্লায় নরসুন্দরদের কান ফাটা আহবান এই যে ভাই অ্যাইসা গেছি – চুল কাটতে তারাতারি অ্যাইসেন। কালের আর্বতে এমনি প্রচারও বন্ধ হয়ে গেছে। সভ্যতার বির্বতনে মানব জীবনের গতিধারায় এসেছে পরিবর্তন, লেগেছে নতুনত্বের ছোয়া। জেন্স পার্লারগুলোতে বাহারি রংঙের হেয়ার স্টাইলের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম-বাংলার হাট- বাজারে পিঁড়িতে বসা অতীতের ‘হাঁটু সেলুন’।
তবে হাঁটু সেলুনে দীর্ঘ প্রায় ৫৮ বছর ধরে চুল কেটে চলেছেন দুই ভাই স্বপন শীল (৭৮) সুনিল শীল (৬৬) এরা দুই ভাই চৌহালী উপজেলার খামার গ্রামের বাসিন্দা। স্বপন শীল ও সুনিল শীল বলে, বাপ দাদার রেখে যাওয়া আদি পেশা আমরা আজও ধরে রেখেছি ‘অর্ধশত বছর ধরে এই পেশায় আছি। আগে বেতিল বাজারে স্থায়ী কোন দোকান ছিলো না। সপ্তাহে দুদিন শনিবার ও মঙ্গলবার এখানে কয়েকজন ব্যবসায়ী পসরা সাজিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। তখন থেকে পিঁড়িতে বসেই হাঁটু সেলুনে চুল ও দাড়ি কাটার কাজ করছি। তখন একজনের চুল কেটে পেতাম ৩ পয়সা এবং দাড়ি ও চুল কাটা দর ছিলো ৫ পয়সা। এখন চুল কাটার দর ৬০ টাকা এবং দাড়ি কাটার দর ৩০ টাকা করে আমরা নেই। এখন প্রতিদিন ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা আয় হয়।
তিনি আরও বলেন, অর্ধশত বছর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাজারের চিত্র বদলে গেলেও আমরা দুই ভাই বদলাই নি। একইভাবে আগের মতই পিঁড়িতে বসে কাজ করে যাচ্ছি। স্বপন ও সুনিল শীল আরও বলেন, এই বাজারটা আগের চেয়ে বড় হয়েছে। এখন প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত ক্রেতাদের ভীড় থাকে।
স্বপন বলেন, আমরা তিন ছেলে একই পেশায় নিয়োজিত থাকলেও তারা মাটিতে নয় সেলুনে কাজ করে। সুনিল শীলের ১ ছেলে সেও সেলুনে কাজ করে।
আর তাদের দুই ভাইয়ের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেলুনে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি না ? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, হাঁটু সেলুনের পিঁড়িতে বসে কাজ করে অভ্যস্থ হয়ে গেছি আমরা। এখন চাইলেও আর সম্ভব না। জীবনের বাকি দিন গুলো যেটুকু সময় পাই এভাবেই কাজ করে জীবনের ইতি টানতে চাই।
চৌহালী উপজেলার শিক্ষক ইদ্দ্রিস আলী জানায়, সদিয়া ইউনিয়নের মধ্যে উল্লেখিত দুই ভাই বয়স্ক নরসুন্দর। অল্প টাকায় পিঁড়িতে বসে চুল ও দাড়ি কাটেন এই দুই ভাই। তাছাড়াও কাজিপুর, তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া কামারখন্দের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই হাঁটুর সেলুন থাকলেও কালের আবর্তে তাদের কাজ ও আয় অনেক কমে গেছে। তাই অনেক শীল পেশা বদলীয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
তাড়াশ, রায়গঞ্জ, বেলকুচি, কামারখন্দ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাপ্তাহিক হাটগুলোতে আজও হাঁটু সেলুন দেখা যায়।
মেছড়া চরের কৃষক আলাউদ্দিন জানায়, আমরা কাম কইরা খাই। টউনে জায়া চুল,দাড়ি কাটার ট্যাহাও নাই সময়ও নাই। তাই আমরা হাঁটু সেলুনে চুল দাড়ি কাটি।
কাজিপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বকুল বলেন, জেলার বিভিন্ন জায়গায় হাঁটু সেলুন আজ বিলুপ্তির পথে। কিন্তু যমুনার হিংস্র থাবায় নিঃস্ব চরাঞ্চল বাসিদের মাঝে এই সেলুন এখনো প্রচলন রয়েছে। একাধারে এরা গরিব এবং খেটে খাওয়া মানুষ। সময় এবং টাকা বাচাতে এরা হাঁটু সেলুনের নিয়মিত গ্রাহক।
উল্লেখ্য, আজ শুধু শহরের নয় গ্রাম-বাংলার প্রতিটি হাট বাজারে অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক সেলুন। যেখানে সাউন্ড বক্সে বাজতে থাকে মন মাতানো গানের সুর। আর সেলুনগুলো উন্নত ডেকোরেশন আর বাহারি রঙের সাজ সরাঞ্জামে সাজানো থাকে। এতে অনেক রকম হেয়ার স্টাইল ঝুলানো থাকে ব্যানারে। কিছু স্টাইল হয় সেলিব্রেটি, নায়ক, গায়ক, খেলোয়ার, ইউটিউবার, ডিজে, টিকটক নামে। ওই স্টাইল দেখে কাটা হয় চুল। সময়ের সঙ্গে সেলুন পেশার চাকচিক্য ও কদর বেড়েছে। বেড়েছে আয়। কমেছে হাট-বাজারে বট বৃক্ষের শীতল ছায়ার নিচে কিংবা প্রখর রোদ্রে লোহার উঁচু শিখে টানানো ছাতায় ঘেরা পিঁড়িতে বসা গ্রাম-বাংলার হাঁটু সেলুনের।