টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের দখলকে কেন্দ্র করে তাবলীগ জামাতের দু’পক্ষ মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ পন্থী দু’পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। জোড় ইজতেমা নিয়ে বিরোধের জেরে বুধবার ভোর রাত ৩টা থেকে এ সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে তিন মুসল্লি নিহত এবং উভয় পক্ষের শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। নিহতদেরকে উভয় পক্ষই তাদের সাথী বলে দাবি করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে গণ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি)।

নিহতরা হলেন, কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার এগারসিন্দু গ্রামের বাচ্চু মিয়া (৭০). ঢাকার দক্ষিন খানের বেড়াইদ এলাকার বেলাল (৬০) ও বগুড়া জেলার তাইজুল ইসলাম (৬৫)।

জানাগেছে, টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে মাওলানা জুবায়ের অনুসারীদের জোড় ইজতেমা শেষে ২০ ডিসেম্বর হতে মাওলানা সাদ অনুসারীদের ৫দিন ব্যাপী জোড় ইজতেমা শুরুর হওয়ার কথা ছিল। জুবায়ের অনুসারীদের কাছ থেকে মাঠ বুঝে নিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে মাঠকে পরবর্তী জোড় ইজতেমার জন্য ২০ তারিখের আগে প্রস্তুতি করার কথা ছিল। কিন্তু জোবায়ের অনুসারীরা তাদের জোড় ইজতেমা শেষে মাঠ ছেড়ে দিয়ে মাঠ দখলে রেখে অবস্থান করতে থাকে। ফলে মাঠে প্রবেশ করতে না পেরে সাদ অনুসারীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এনিয়ে গত কয়েকদিন ধরে উভয়পক্ষের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। টঙ্গী ও বাসন থানা এলাকায় প্রতিপক্ষের উপর হামলা ও সড়ক অবরোধসহ একাধিক ঘটনা ঘটে। এদিকে, মাওলানা সাদ অনুসারীরা তাদের জোড় ইজতেমায় অংশ নিতে গত কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে টঙ্গীতে এসে জড়ো হতে থাকে। জুবায়ের পন্থীরা মাঠে অবস্থান করতে থাকায় তারা ইজতেমা ময়দানের আশেপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, বেশ কিছুদিন ধরেই তাবলীগ জামাতের মাওলানা সাদ অনুসারীদের জোড় ইজতেমাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। মাওলানা জুবায়ের অনুসারীরা গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাওলানা জুবায়ের অনুসারীরা জোড় ইজতেমা পালন করেন। এরপর ২০ ডিসেম্বর থেকে মাওলানা সাদ অনুসারীরা জোড় ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিলে তাদেরকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে ইজতেমা ময়দানে অবস্থান নেন জুবায়ের অনুসারীরা। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা থেকে সাদ অনুসারীদের ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ ঠেকাতে ময়দানের চারপাশে ও বিভিন্ন সড়কের মোড়ে লাঠি হাতে পাহারা বসায় জুবায়ের অনুসারীরা। এক পর্যায়ে বুধবার ভোর রাত ৩টার দিকে সা’দ অনুসারীরা তুরাগ নদীর পশ্চিম তীর থেকে কামারপাড়া ব্রীজসহ বিভিন্ন সড়ক দিয়ে ময়দানের বিদেশী গেইট ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে ময়দানের ভেতর থেকে জুবায়ের পন্থী মুসুল্লীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এসময় উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা শুরু হয়। রাতের আঁধারে সংঘর্ষ ও চিৎকারে আশেপাশের এলাকায় আতঙ্ক দেখা দেয়। একপর্যায়ে জোবায়ের অনুসারীরা মাঠ ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং মাঠ দখলে নেয় সাদ অনুসারীরা। সংঘর্ষে তিনজন মুসুল্লী নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন।

খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে গণ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি)। গণ বিজ্ঞপ্তি জারির পর বিকেলের মধ্যেই ইজতেমা ময়দান ত্যাগ করে মুসুল্লীরা।

মাওলানা জুবায়ের পন্থি তাবলীগ জামাতের (শুরায়ে নেজাম) মিডিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান ও কয়েক মুসুল্লী জানান, মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মাওলানা জুবায়ের সাহেবকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে জানানো হয় বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দুপুর ১২টায় আমাদের সাথে (জুবায়ের পন্থি) মিটিংয়ে বসবে এবং বিশ্ব ইজতেমা মাঠের বিষয়ে সুন্দর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে। অথচ গতকয়েকদিন ধরে সারা দেশ থেকে সাদ পন্থী মুসুল্লীরা টঙ্গীসহ আশেপাশের এলাকায় এসে জড়ো হতে থাকে। মঙ্গলবার দিবাগত রাতে তারা ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম পাশে বেলাল মসজিদ ও আশেপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়। বুধবার ভোর রাত ৩ টার দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের নতুন, পুরাতন সাথীরা ধারালো অস্ত্রশস্ত্রসহ তুরাগ নদীর পশ্চিম তীর থেকে কামারপাড়া ব্রীজসহ বিভিন্ন সড়ক দিয়ে ময়দানের বিদেশী গেইট ভেঙ্গে ময়দানের ভিতরে প্রবেশ করে মুসুল্লীদের উপর হামলা চালায়। এতে তিনজন মুসুল্লী নিহত ও শতাধিক আহত হন।

সাদ পন্থি তাবলীগ জামাতের মুরুব্বী সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম বলেন, ২০ ডিসেম্বর টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে তাদের জোড় ইজতেমা শুরুর হওয়ার কথা ছিল। মাঠ প্রস্তুতির জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাঠের আশপাশে সড়কে পাশে মুসল্লিরা এসে অবস্থান নিচ্ছিলেন। আমাদের এ প্রস্তুতি দেখে জোবায়ের পন্থি মুসুলিরøা আমাদের লোকজনের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে আমাদের লোকজন ইজতেমা মাঠে ঢুকে পড়ে। এতে আমাদেও ৩জন সাথী ভাই নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হন। আহতদের টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে ইজতেমা ময়দানে এক প্রেসব্রিফিংয়ে সা’দপন্থী মুয়াজ বিন নূর বলেন, রাত ৩টার দিকে জুবায়ের পন্থীরা আমাদের সাথীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে আমাদের শত শত সাথী ধাওয়া দিলে তারা ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়। তখন আমাদের সাথীরা ময়াদনে ঢুকে যায়।

শ্রীপুরে জুবায়ের পন্থীদের মহাসড়ক অবরোধ

জুবায়ের পন্থী অনুসারীদের উপর হামলা চালিয়ে সাথীদের হতাহত করার ঘটনার বিচার ও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দান দখল জুবায়ের পন্থীদের বুঝিয়ে দেয়ার দাবিতে শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে জুবায়ের অনুসারীরা। মুলাইদের পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় প্রায় আড়াইঘন্টা মহাসড়ক অবরোধ করে তারা।

ইজতেমা মাঠে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে গণবিজ্ঞপ্তি

টঙ্গীর ইজতেমা মাঠের দখল নিয়ে মাওলানা জুবায়ের ও সাদ পন্থি মুসুল্লিদের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে গণ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি)। বুধবার দুপুরে জিএমপি’র কমিশনার ড. মোঃ নাজমুল করিম খান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ আদেশ জারি করেন।

গণ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুর ২ টা থেকে বিশ্ব ইজতেমা মাঠে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকার মধ্যে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একত্রে ঘোরাফেরা, জমায়েত এবং কোন মিছিল সমাবেশ করতে পারবে না। কোন প্রকার অস্ত্রশস্ত্র, ছুরি, লাঠি, বিস্ফোরক দ্রব্যাদি বা এ জাতীয় কোন পদার্থ বহন করতে পারবে না। কোন প্রকার লাউড স্পীকার বা এ জাতীয় কোন যন্ত্র দ্বারা উচ্চস্বরে কোন শব্দ করতে পারবে না। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জনস্বার্থে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) আইন ২০১৮ এর ৩০ ও ৩১ ধারায় এই গণ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।

জিএমপি’র টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ইস্কান্দার হাবিব জানান, ইজতেমা ময়দান এলাকায় দু’পক্ষের সংঘর্ষেও ঘটনায় এখনো পর্যন্ত থানায় মামলা দায়ের করেন নি কেউ। তবে সকাল থেকে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সেনাবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। আমরা এ পর্যন্ত তিন মুসুল্লীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হতে পেরেছি। এসময় শতাধিক মুসুল্লী আহত হয়েছেন। জিএমপি কমিশনার দুপুরে গণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার পর বিকেল ৩টা থেকে মুসুল্লিরা মাঠ ছেড়ে চলে যেতে থাকে।

এদিকে, তাবলীগ জামাতের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় ইজতেমা ময়দানে আগত তাজুল ইসলাম (৬০) নামের আরো এক মুসুল্লী নিহত হয়েছেন। তাকে গলা কেটে হত্যা করে লাশ সাদ পন্থীরা গুম করেছে বলে দাবী করেছেন তাবলীগ জামাত বাংলাদেশ (শুরায়ী নেজাম) এর মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান। বুধবার রাতে সংগঠণের পেইজে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান তিনি। এ নিয়ে ইজতেমা ময়দানে তাবলীগ জামাতের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় চারজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

হাবিবুল্লাহ রায়হান জানান, নিহত তাজুল ইসলাম বগুড়া জেলা সদর থানার নাড়ুলি সাবগ্রামের বাসিন্দা এবং তাবলীগ জামাত বাংলাদেশ শুরায়ী নিজামের সাথী। বুধবার সকালে তাজুলকে খাসির মতো জবাই করে হত্যা করে সাদপন্থীরা। পরে নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে নিহতের লাশ গুম করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে লুকিয়ে রাখে তারা। এদিকে নিহতের লাশ পাওয়ার জন্য তার পরিবারের সদস্যরা বারবার আকুতি জানানোর এক পর্যায়ে রাতে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পেইজে তিনি গলা কাটা রক্তাক্ত এক নিহত ব্যাক্তির ছবি পোস্ট করেন।

এব্যাপারে জিএমপি’র টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ইস্কান্দার হাবিব বুধবার রাত সোয়া ৯টার দিকে জানান, তাজুল নামের একজনকে গলা কেটে হত্যার ঘটনাটি আমার জানা নেই। তাবলীগ জামাতের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় এখনো পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর সংবাদ আমি পেয়েছি।

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, গাজীপুর ও নুরুল ইসলাম, টঙ্গী ॥