• মনির হেসেন বেনাপোল প্রতিনিধি: ১১ ডিসেম্বর বাঙালীর জাতীয় জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন। কেবল যশোর নয়, দেশবাসীর জন্যেও দিনটি গৌরবের। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জেলা শহর হিসেবে প্রথম পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয় যশোর। আর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জনসভাটিও হয় এ জেলা শহরেই। ঐতিহাসিক টাউনহল মাঠের সেই দিনটি আজ।
    পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত বাংলাদেশের মাটিতে যশোর টাউন হল ময়দানের এই প্রথম জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মেদ।

ওই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সংসদ সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার, রওশন আলী, মোশাররফ হোসেন, তবিবর রহমান সরদার, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি সম্পাদক মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, দপ্তর সম্পাদক আশরাফ আলী, লেখক এম আর আকতার মুকুল, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান প্রমুখ।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মেদ সর্বস্তরের মানুষকে স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনায় দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আর ধ্বংস নয়, যুদ্ধ নয়। এ মুহূর্তে কাজ হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা’।

একই সঙ্গে তিনি সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনারা আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। অপরাধী যেই হোক, তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করবেন।’
তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘স্বাধীন দেশে ধর্ম নিয়ে আর রাজনীতি চলবে না। আর তাই জামায়াত, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো’।
তিনি জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের কাজ হল, যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা।’ স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগে দেশবাসীকে আহ্বান জানান।
এ জনসভা যখন হয়, তখন যশোরের আশপাশে যুদ্ধ চলছিল। বিশেষত, খুলনায় তখনও পাকিস্তানি সেনারা শেষ চেষ্টা হিসেবে যুদ্ধ করছিল। খুলনা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর। এর আগের দিন ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রায় এক লাখ সেনা আত্মসমর্পণ করে।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে যশোর শহরে আসেন। আর জনসভা শেষে যশোর সড়কপথে কোলকাতা ফিরে যান।

মুক্ত দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম এ জনসভার খবর সংগ্রহে উপস্থিত ছিলেন লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক পিটার গিল, নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সিডনি এস এইচ সানবার্গ, বালটিমোর সান পত্রিকার প্রতিনিধি, ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিনিধিসহ বহু বিদেশি সাংবাদিক।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর যশোরে সকালে ও দুপুরে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের সঙ্গে ভারতীয় নবম পদাতিক ও চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রচণ্ড লড়াই হয়। বিকেলেই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা বুঝে যান, যশোর দুর্গ আর কোনোভাবেই রক্ষা করা সম্ভব নয়।

প্রাচ্যের স্টালিনগ্রাড’ খ্যাত যশোর সেনানিবাসের পতন হওয়ার পরই পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এ দুর্গের পতনের পরই পূর্বাঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ নিয়াজির অভিমত উদ্ধৃত করে এক বার্তায় বলা হয়, ‘যশোরের বিপর্যয়ের ফলে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের পতন প্রায় আসন্ন …। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া না গেলে জীবনরক্ষার জন্য বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয়।’
তিনি আরও বলেন, সেদিন তাজ উদ্দিন আহম্মেদ মুসলিম লীগ, জামাতসহ ধর্ম ভিত্তিক সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
এদিনই বেনাপোল অঞ্চলে দায়িত্বরত লে. কর্নেল শামসকে নওয়াপাড়ার দিকে দ্রুত সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন ব্রিগেডিয়ার হায়াত। আর নিজের ব্রিগেড নিয়ে রাতের আঁধারে খুব গোপনে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে তিনি পালিয়ে যান খুলনার দিকে। ৬ ডিসেম্বর এভাবেই একাত্তরে প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা হওয়ার গৌরব অর্জন করে যশোর। আর ১১ ডিসেম্বর যশোরের টাউনহল মাঠের উন্মুক্ত মঞ্চে স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রবাসী সরকারের প্রথম জনসভায় সৃষ্টি হয় এক নতুন ইতিহাস।