অর্থাভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর চাকরির সন্ধানে ঢাকায় গিয়ে মাত্র ১২ হাজার টাকার বেতনে একটি ডিজিটাল মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে সেই কাজও হারিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়ে বাড়ি ফিরে আসেন। এসময় ঝিনুকে মুক্তা চাষের একটা সাফল্যময় গল্প ইউটিউবে দেখে উৎসাহিত হন। এরপর স্থানীয় মৎস বিভাগের মাধ্যমে মুক্তা চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি ঝিনুকে মুক্তা চাষ শুরু করেন। এই মুক্তা চাষ করে সাফল্যও পেয়েছেন। সাড়া ফেলেছেন এলাকাজুড়ে। শুধু তাই নয়, হয়ে উঠেছেন একজন উদ্যোক্তা ও তার গ্রামের ‘আইকন’।
বলছি নওগাঁর আত্রাই উপজেলার পাঁচুপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা জগদাস গ্রামের যুবক কবির হোসেন (২৬)। কবির হোসেন ওই গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলামের ছেলে। কবিরের এই কর্মকাণ্ড দেখে এলাকাবাসী প্রথমে পাগল হিসেবে আখ্যায়িত করলেও সাগরের মুক্তা পুকুরে চাষ করে সফলতা আসায় গ্রামের নামও পাল্টে গেছে। জগদাস গ্রাম এখন ‘মুক্তার গ্রাম’ হিসাবে পরিচিত পেয়েছে। তার এই মুক্তা চাষ প্রকল্পের গ্রামের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানও হয়েছে।
জানা যায়, স্থানীয় মৎস বিভাগের মাধ্যমে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে ময়মনসিংহে মুক্তা চাষের ওপর তিনদিনের প্রশিক্ষণ নেন কবির হোসেন। এরপর গ্রামে ফিরেই মাত্র ৪০ শতকের একটি পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষের পাশাপাশি ঝিনুকে মুক্তা চাষের প্রকল্প হাতে নেন। চেষ্টা আর মেধা দিয়ে মুক্তা চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে সারা দেশের ২শ বেকার যুবককে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আবার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এসব যুবকদের মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক বেকার যুবক পুকুরে মুক্তা চাষ করছেন।
কবির হোসেনের ওই পুকুরে গিয়ে দেখা যায়, পানিতে তিন ফুট পর-পর ভাসছে ফাঁকা প্লাস্টিকের বোতল। সেখানে পানির এক ফুট নিচে রয়েছে একটি করে প্লাস্টিকের ডালা। সে সব ডালার প্রতিটিতে রয়েছে ১৫-২০টি করে জীবন্ত ঝিনুক। এভাবে ওই পুকুরে প্রায় আট হাজার ঝিনুক চাষ করছেন। ঝিনুকের মধ্যে প্রতিটিতে কমপক্ষে দুটি করে বিভিন্ন ডিজাইনে নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। একটি নির্দ্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এসব ঝিনুক থেকেই উৎপাদন হচ্ছে বিভিন্ন ডিজাইনের মুক্তা।
এসব বিষয়ে কবির হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, প্রথমেই আমি আট হাজার ঝিনুকের মধ্যে বিভিন্ন ডিজাইনের প্রায় পনের হাজার নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করে। এসময় কিছু ভুলের কারণে প্রথম তিন মাসের মধ্যে বেশ কিছু ঝিনুক মারা যায়। তবে পরে আর আমাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথম বছরেই পুকুরে মুক্তা চাষ করে সব ধরনের খরচ বাদে আমার আয় হয় পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। বর্তমানে আমি তিন পুকুর লিজ নিয়ে মাছের পাশাপাশি মুক্তা চাষ করছি। এসব পুকুরে বর্তমানে ৪০ হাজার ঝিনুকে মুক্তা চাষ হচ্ছে। পুকুর লিজ, ঝিনুক সংগ্রহ, পরিচর্যা, নিউক্লিয়াস ক্রয় ও সংস্থাপন ইত্যাদি বাবদ মোট খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। এই এক বছরে ওই ঝিনুক থেকে উৎপাদিত মুক্তা ২৪ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করছেন। ইতোমধ্যে তিনি ৫শ ঝিনুক সংগ্রহ করে বিক্রি করেছেন প্রায় ১ লাখ টাকায়।
এই উদ্যোক্তা আরও বলেন, মুক্তা দুই ধরনের রয়েছে একটি প্রাকৃতিক মুক্তা ও একটি ডিজাইন মাক্তা। এই ডিজাইন মুক্তাই বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুকুরে চাষ হচ্ছে। এসব মুক্তার বাজার রয়েছে ভারতের কলকাতায় এবং বাংলাদেশে আড়ং নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। তার এই মুক্তা চাষ প্রকল্পের গ্রামের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানও হয়েছে। বর্তমানে তার প্রজেক্টে ৮ থেকে ৯ জন বেকার যুবক কর্মরত রয়েছে। তারা প্রতিমাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা মজুরি পাচ্ছেন।
ওই প্রকল্পে কর্মরত আইনুল, সাজু, সাজেদুর, সুমন ও হাফিজুল বলেন, আগে গ্রামে বেকার অবস্থায় ঘুরে বেরাতাম। কিন্তু বাড়ির খেয়ে নিজ গ্রামেই এখন উর্পাজন করতে পারছি এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে। শুধু তাই নয়, তার সফলতা দেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা অন্তত ২শ বেকার যুবককে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কবির হোসেন। প্রতিদিনই তার নিকট লোকজন আসছেন পুকুরে মুক্তা চাষ বিষয়ে জানতে। একইভাবে কবিরের সাফল্য দেখে তার সঙ্গে মুক্তা চাষে যোগ দেন গ্রামের আরও ২০ বেকার যুবক। ইতোমধ্যেই গ্রামটি এখন মুক্তা চাষির গ্রাম হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।
জগদাস গ্রামের আবু বাশার ও মানিক নামের দুই উদ্যোক্তা জানান, কবিরের সাফল্য তাদেরও মুক্তা চাষের দিকে আকৃষ্ট করেছে। ইতোমধ্যে ওই দুই যুবকসহ গ্রামের প্রায় ২০ জন বেকার যুবক ঝিনুকে মুক্তা চাষের ছোট ছোট প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। তারাও আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য রহিমা বিবি বলেন, কবিরের কাজ দেখে গ্রামের লোকজন তাকে পাগল বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল করতেন। এখন তারাই তার প্রশংসা করছে। বর্তমানে কবিরের জন্যই গ্রামের নাম হয়েছে মুক্তার গ্রাম। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছেন। এলাকার অর্থনীতির চাকাও সচল হয়ে উঠেছে। পাল্টে গেছে এলাকার সার্বিক চিত্র।
আত্রাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা পলাশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ইতোমধ্যেই উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে মুক্তা চাষের সম্ভবনা উজ্জল হয়ে উঠেছে। ব্যাপকভাবে সাড়া পাওয়ায় মুক্তা চাষে ঝুঁকি কম ও লাভজনক। মানসম্মত মুক্তা চাষ করতে পারলে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। তাই মানসম্মত মুক্তা চাষে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সার্বিক প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
মোঃ খালেদ বিন ফিরোজ
নওগাঁ প্রতিনিধি