গাজীপুরে বেতন-ভাতা নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বন্ধ থাকা টিএনজেড অ্যাপারেলস কারখানাটি ২৩ দিন পর খুলে দেয়া হয়েছে। শনিবার সকাল থেকেই শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছেন। এর আগে ওই কারখানা কর্তৃপক্ষের ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের দেয়া কথা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের আগেই গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সকল শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়। এদিকে, একইদিন বকেয়া বেতনভাতা পরিশোধের দাবিতে ৯ ঘন্টা ধরে চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকেরা।
কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকরা জানায়, গাজীপুর মহানগরীর মোগরখাল এলাকার টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড গ্রুপের ৫টি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধ ও বন্ধ হওয়া কারখানা চালু করাসহ কয়েক দফা দাবিতে আন্দোলন করে। সর্বশেষ বেতন ভাতার দাবিতে তারা গত শনিবার (৯নভেম্বর) হতে সোমবার (১১ নভেম্বর) রাত ১০টা পর্যন্ত টানা তিনদিন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। ওইদিন বিকেলে আন্দোলনরত শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে শ্রম মন্ত্রণালয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করেন বিজিএমইএ ও কারখানা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণ। বৈঠকে শ্রমিকদের পাওনাদি দু’দফায় ১৭ নভেম্বর (রবিবার) ও ৩০ নভেম্বর পরিশোধ করার এবং বন্ধ কারখানাগুলো শীঘ্রই খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম দফা রবিবারের আগেই বৃহষ্পতিবার শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হয়। শনিবার থেকে কারখানা খোলা থাকার নোটিশ শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের পর কারখানার সামনে নোটিশ টানিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী শ্রমিকরা যথারীতি শনিবার সকাল থেকে কাজে যোগদান করে।
শ্রমিকদের একজন শরিফা বেগম জানান, এখন আমাদের মধ্যে কোন অসন্তোষ নেই, আমরা সকলে আন্তরিকতার সাথে কাজে যোগ দিয়েছি। আজকে কাজে ফিরে যেন সকলের মাঝে ঈদের আনন্দ বিরাজ করছে। কারখানায় এই কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি কারখানার মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কারখানার নির্বাহী পরিচালক মাকসুদুল রহমান চৌধুরী জানান, কদিন আগে বকেয়া বেতন নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হলেও তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করায় শনিবার থেকে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছেন। এখন কারখানার মধ্যে আর কোন যোগাযোগ নেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই শ্রমিকরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে প্রফুল্ল চিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন। এ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সহায়তার জন্য তিনি শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্থানীয় প্রশাসন, বিজিবি, পুলিশ, সাংবাদিকসহ সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বাসন থানার ওসি মোঃ রাহেদুল ইসলাম জানান, শনিবার সকালে টিএনজেড গ্রুপের কারখানার পোশাক শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছেন। কারখানাগুলোতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে, এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা নেই।
অপরদিকে, গাজীপুরের বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকেরা অক্টোবর মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক শনিবার সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় সোয়া ৯ ঘন্টা অবরোধ করে রেখেছে। এতে ওই মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
শিল্প পুলিশ ও কারখানার শ্রমিকরা জানায়, গাজীপুর মহানগরের চক্রবর্তী এলাকাস্থিত বেক্সিমকো ইড্রাস্টিয়াল পার্কে বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পার্কের এসব পোশাক ও সিরামিক কারখানায় প্রায় এক চল্লিশ হাজার কর্মী রয়েছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুথানের পর গত কয়েক মাস ধরে শ্রমিকরা নিয়মিত বেতনভাতা পাচ্ছে না। প্রতিমাসেই আন্দোলন করে তাদের বেতন আদায় করতে হচ্ছে। কারখানাগুলোর শ্রমিকদের গত অক্টোবর মাসের বেতন ভাতা শনিবার (১৬ নভেম্বর) পরিশোধ করা হয়নি। এতে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। শনিবার সকালে শ্রমিকরা কারখানার গেইটে জড়ো হয়ে তাদের বেতন ভাতা পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। এক পর্যায়ে সকাল পৌণে ৯টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে কারখানার পার্শ্ববর্তী চক্রবর্তী এলাকায় চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়কের উপর অবস্থান নিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এতেই ওই সড়কের উভয়দিকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন ওই সড়কে চলাচলকারী যাত্রীরা। খবর পেয়ে শিল্প ও থানা পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়কের উপর থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও শ্রমিকরা তাদের দাবিতে অনঢ় থেকে রাতভর সড়কের উপর অবস্থান করতে থাকে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত প্রায় সোয়া ৯ঘন্টা ধরে শ্রমিকদের অবরোধ চলছিল।
শিল্প পুলিশ আরো জানায়, বেক্সিমকো পার্কে স্টাফসহ ৪১ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের প্রতি মাসের বেতনের পরিমান হয় ৮০ থেকে ৮২ কোটি টাকা। প্রতিমাসের ৭ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে তাদের বেতন দেয়া হতো। কিন্তু মালিকদের কেউ না থাকায় এখন বেতন ঠিকমতো পাচ্ছেন না। যার কারণে তারা গত বৃহস্পতিবার থেকে আন্দোলন শুরু করে। গতকাল শুক্রবার থাকায় তারা আন্দোলনে যায়নি। শনিবার সকাল পৌণে ৯ টা থেকে তারা চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করে আছে। এতে মহাসড়কের উভয়দিকে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার পযন্ত যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
জিএমপি’র কাশিমপুর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম জানান, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধের দাবিতে শনিবার সকাল পৌনে নয়টা হতে চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়কে অবরোধ করে। সন্ধ্যা ৬টার দিকেও শ্রমিকদের অবরোধ অব্যহত রয়েছে। এতে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকরা বলছে, বকেয়া বেতন প্রদানের আশ্বাস না পেলে তারা মহাসড়ক ছেড়ে যাবে না।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, ঘটনাস্থলে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা রয়েছে। তারা শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন।