ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘বে অফ বেঙ্গল সংলাপ’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এই সম্মেলনে আগামী কয়েক দিন ধরে আমরা যখন আলোচনা করব এবং আমাদের চিন্তাভাবনা ভাগাভাগি করব, আমি আপনাদের অনুরোধ করব কীভাবে একটি নতুন বিশ্ব গড়া যায় তা নিয়ে ভাবতে। আমাদের যুবসমাজ আমাদের নতুন বাংলাদেশ তৈরির পথে পরিচালিত করেছে। সম্মেলন আয়োজন করায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই সম্মেলন শুধুমাত্র মতবিনিময়ের স্থান নয়; এটি আমাদের অভিন্ন সহনশীলতার প্রমাণ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সবসময় স্বপ্ন, কঠোর পরিশ্রম এবং অবিচ্ছেদ্য ইচ্ছা পূরণের দেশ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। এটি এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক, কারণ বিপ্লবের আকাঙ্খাগুলো এখনও সবার মনে সতেজ। এই আকাঙ্খা লাখো কণ্ঠের আওয়াজ, প্রায় পুরো জাতির আওয়াজ- তারা পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। আমাদের সকলকে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তির ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যত গড়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে তিন দিনব্যাপী এ সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন যে, তিনি সবসময়ই একজন আশাবাদী মানুষ এবং উদ্ভাবনী ধারণা ও কল্পনার শক্তিতে বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন, ‘যদি আমরা একসঙ্গে কল্পনা করতে পারি, তাহলে সেটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আসুন আমরা এটি করি।’

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এমন একটি অর্থনীতি গড়ার ওপর জোর দিয়েছেন যেখানে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সকল মানুষের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া যাবে। তিনি বলেছেন, ‘আসুন আমরা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করি, একে অপরের কথা শুনি এবং একটি নতুন পৃথিবী কল্পনা করার সাহস করি যা পরিবেশগতভাবে নিরাপদ পৃথিবীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলি যেখানে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফল সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে, শুধুমাত্র কিছু বিশেষ সুবিধাভোগীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।’

একটি নতুন সভ্যতা গড়ার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বিদ্যমান সভ্যতা আমাদের ব্যর্থ করেছে। শুধুমাত্র পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি আত্মধ্বংসী সভ্যতা হয়ে উঠেছে। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্পদের চরম সঞ্চয়ের দিকে পরিচালিত করেছে। তিনি কল্যাণমূলক দেশ গড়ে তুলতে তিন শূন্যের ধারণার ওপর ভিত্তি করে একটি পৃথিবী তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই ধারণা হলো-শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদের কেন্দ্রীকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব। এজন্য, তিনি সামাজিক ব্যবসা প্রচলনের কথা বলেন, যা মানুষের সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দেয়, কেবলমাত্র মুনাফা করা যার মূল উদ্দেশ্য নয়। একই সঙ্গে যুবকদের চাকরিপ্রার্থী না বানিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ওপরও জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা।

অধ্যাপক ইউনূস উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য দ্রুত ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান এবং এমন একটি অর্থনীতি গড়ার উপর জোর দেন যেখানে সবাই উপকৃত হবে। তিনি বলেন, আমাদের অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের ফ্রন্টলাইনে রয়েছে। প্রতি বছর আমাদের উপকূলীয় জনগোষ্ঠী বর্ধিত পানি এবং পরিবর্তিত আবহাওয়ার প্রভাবে জীবন, ঘরবাড়ি এবং জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে। এই সংকট এমন যা পরবর্তী সময়ের জন্য ফেলে রাখা যায় না; এটি অবিলম্বে এবং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার দাবি রাখে।

তরুণদের সম্ভাবনা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা একই সঙ্গে অপরিসীম সম্ভাবনার একটি অঞ্চল। আমাদের দেশ তরুণদের দেশ। ১৭১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ২৭ বছরের নিচে। এটি আমাদের দেশকে সৃজনশীলতায় অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলেছে। যুবসমাজের মধ্যে টেকসই উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়ার এবং আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবুজ প্রবৃদ্ধির মডেল তৈরির ক্ষমতা রয়েছে। তবে এজন্য প্রয়োজন সহযোগিতা, সাহস এবং অমিত ভবিষ্যতকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রতি অটুট বিশ্বাস।

প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, এ বছর সম্মেলনের বিষয়বস্তু, ‘একটি বিভক্ত বিশ্ব’ গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। কারণ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যা চ্যালেঞ্জ ও জটিলতায় পরিপূর্ণ। তিনি বলেন, হোক তা অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অন্যায়, বা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি, আমরা এমন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি যা অত্যধিক। তবুও, বাংলাদেশে আমরা সহনশীলতা সম্পর্কে কিছু জানি, প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়া এবং তা থেকে সুযোগ তৈরি করা সম্পর্কে কিছু জানি। এটি আমি কয়েক দশক আগে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কাজ করার সময় শিখেছি, তাদের সাহস দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি।’

অধ্যাপক ইউনুস বলেন, ‘এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে শিখিয়েছে যে, যদি আমাদের ধৈর্য থাকে সমস্যাকে গভীরভাবে বোঝার, চেষ্টা করার সাহস থাকে এবং লেগে থাকার সংকল্প থাকে, তবে প্রতিটি সমস্যার একটি সমাধান আছে।’ অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বক্তব্য রাখেন। খবর-বাসস