ডেস্ক রিপোর্ট : ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার মধুখালী, আলফাডাঙ্গা এই ৩ উপজেলা নিয়ে ফরিদপুর-১ আসন গঠিত। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগের পর বিএনপি আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে দলীয় কার্যক্রম শুরু করেছে। ফরিদপুর-১ আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন এরই মধ্যে পেতে কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহ-সভাপতি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

স্থানীয় বিএনপি’র নেতাকর্মীদের অভিযোগ খন্দকার নাছির বিএনপি’র ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করে আওয়ামী লীগের সমর্থিত একাধিক চেয়ারম্যান এবং পদধারী আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে বিএনপিতে যোগদান করিয়ে তার মাঠ গোছাচ্ছেন। এ নিয়ে স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

এই আসনের একাধিক বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে মধুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য এবং উপজেলার রায়পুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জাকির মিয়া এবং উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান টিপু। ১৯ অক্টোবর মধুখালীর একটি নৌকা বাইচ অনুষ্ঠানে ফুল দিয়ে খন্দকার নাছিরুলের হাত ধরে বিএনপিতে যোগদান করেছে। মেগচামী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাব্বির, ডিবি প্রধান হারুনের ক্যাশিয়ার হিসেবে খ্যাত বোয়ালমারী উপজেলার রুপাপাত ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সোনা মিয়া খন্দকার নাছিরের সাথে যোগদান করেছেন। কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী হিরু মুন্সি গত মাসে খন্দকার নাছিরের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগদান করেন।

(আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমানের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে যোগদান জাকির চেয়ারম্যান )

বিএনপির নেতারা আরো অভিযোগ করে বলেন, খন্দকার নাছির এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনিকে দিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে চাঁদাবাজি করেছে। এমনকি নাছিরের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তার উপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির নেতা সৈয়দ টুটুল খন্দকার নাছিরের সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজীর বিরোধীতা করলে গত ১৬ আগস্ট তাকে কুপিয়ে জখমও করে তার সন্ত্রাসী বাহিনি।

(বিএনপি নেতা সৈয়দ  টুটুলকে কুপিয়া আহত করে খন্দকার নাসিরের সন্ত্রাসী বাহিনী)
বিএনপির নেতারা আরো জানান, মধুখালি রাজ্জাক জুটি মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার খানের থেকে একটি মোটর সাইকেল এবং নগদ ৫ লক্ষ টাকা চাঁদা নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে । মধুখালী উপজেলা কৃষকদলের আহবায়ক মেহেদী হাসান মুন্নু একদিনের কথা বলে বাসার খানের মোটরসাইকেলটা এনে আর ফেরত দেয় নাই। এই আসনের তিন উপজেলার বিভিন্ন মিল ও কারখানা থেকেও চাঁদা নিয়েছে নাছিরের সন্ত্রাসী বাহিনী।

বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর গ্রামের ছেলে খন্দকার নাছিরুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহ-সভাপতি। তবে ৯০ এর দশকের শুরুর দিকে জাতীয় পার্টির রাজনীতি দিয়ে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু। ৯৪ সালের শেষের দিকে তিনি জাতীয় পার্টির ছেড়ে দিয়ে জাসদে, তারপর যোগদান করেন বিএনপিতে । ১৯ ৯৬ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে হাতী মার্কায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ফরিদপুর ১ আসনের নির্বাচনে জয়লাভ করেন তিনি। যদিও সে সরকারের মেয়াদ ছিলো ১৩ দিন।

গত ৫ই আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে তিনি তার নিজ এলাকায় আগমন করেন এবং দলীয় মনোনয়ন পেতে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন মিটিং মিছিলে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবার ঘোষনাও দিয়েছেন তিনি। এদিকে বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের নির্যাতন, হামলা ও মামলা সহ্য করে যেসব বিএনপির নেতারা মাঠে ছিলেন তাদের মূল্যায়ন না করে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ নেতাদের দলে ভিড়িয়ে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করায় তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে এই আসনের তিনটি উপজেলা বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে।
বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির নেতা টুটুল বলেন, আমি বোয়ালমালী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারন সম্পাদক সামছুদ্দিন ঝুনু ভাইয়ের সমর্থনে বিএনপির রাজনীতিতে সাংগঠনিক কাজ করি। আমাকে খন্দকার নাছির ঝুনু ভাইয়ের সাথে থাকতে নিষেধ করেন এবং তার সাথে দল করতে প্রস্তাব দেন। খন্দকার নাছিরের বাড়ি আমার বাড়ি পাশাপাশি। তবুও আমি আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতন ও মামলা সহ্য করে ঝুনু ভাইয়ের সাথে কাজ করেছি। আমি ঝুনু ভাইকে এখন কিভাবে ফেলে চলে যাই। এজন্য খন্দকার নাছির তার আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসী বাহিনি দিয়ে গত ১৬ আগষ্ট আমাকে কুপিয়ে জখন করে। তার নির্দেশ ছিলো আমাকে মেরে ফেলার। আল্লাহ আমাকে হায়াত দিয়েছে এজন্য বেঁচে আছি। তিনি বলেন, বৈষশ্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমি সক্রিয় ভূমিকা পালন করি। আর খন্দকার নাসির ঢাকা বসে ছিলো। স্থানীয় বিএনপির কারো সাথে তার যোগাযোগ নাই। ৫ আগস্টের পর হঠাৎ করে তার এই আসনের রাজনীতিতে উদয় হয়।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খোকন বলেন, খন্দকার নাছিরুল ইসলাম ফরিদপুর-১ আসনে বিএনপির দল করতে আসেনি। এসেছেন চাঁদাবাজী ও সন্ত্রাসী কাজ করে টাকা ইনকামের জন্য। তিনি বিএনপিতে আওয়ামীলীগের পদধারী লোকদের যোগদান করিয়ে সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করতে চাচ্ছেন। খন্দকার নাছিরের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তার উপর হামলা হচ্ছে। তিনি বলেন, অর্থের লেনদেনের মাধ্যমে আলফাডাঙ্গা আদর্শ একাডেমিতে ফরিদপুরের ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার মামলার আসামী আরিফুর রহমান দোলনের স্ত্রী কে সভাপতি হিসেবে মনোনিত করেছেন। এতে কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। কিন্তু কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। গত ৭ নভেম্বর বোয়ালমারীতে বিপ্লব ও সংহতি দিবসের অনুষ্ঠানে ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিল্টন খান তার বক্তব্য বলেন, খন্দকার নাসির বিএনপির কেউ না। আমরাই ছাত্রদল থেকেই আজ বিএনপি করি, তিনি অন্যদল থেকে এই দলে এসে জুড়ে বসেছেন। একটি সূত্রে জানা যায়, সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমানের সমর্থিত ঘোষপুর ইউনিয়নের
মধুখালী উপজেলার বাসিন্দা এবং যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির বলেন, খন্দকার নাছিরুল ইসলাম দলীয় হাই কমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে দলে আওয়ামী লীগের নেতাদের যোগদান করাচ্ছেন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন তিনি। যদিও ৫ বছর আগে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে একবার বহিস্কারও হন তিনি। কেন্দ্রীয় ভাবে খন্দকার নাছিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সুপারিশ করবো।
বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির সাবেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্থানীয় রাজনীতিতে খন্দকার নাছির কখনোই সক্রিয় ছিলো না। তাকে এ অঞ্চলের মানুষ ও বিএনপির নেতারা তেমন চিনেও না। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে তিনি এলাকায় এসে এই আসনের বিএনপির রাজনীতির হাল ধরার করেন। কিন্তু তার সাংগঠনিক কার্যক্রম, আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে দল গঠন এবং চাঁদাবজীর মতো অভিযোগ রয়েছে। যা দলের জন্য চরম ক্ষতি বয়ে আনবে।
তিনি বলেন, চেয়ারম্যান জাকির মিয়া, চেয়ারম্যান টিপু ছিলেন ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মৎস মন্ত্রী আব্দুর রহমানের ঘনিষ্টজন। চেয়ারম্যান সোনা মিয়া ছিলেন ডিবি পুলিশ প্রধান পলাতক হারুনের ক্যাশিয়ার। হারুনের সকল টাকার হিসাব রাখতেন এই সোনা মিয়া। এদের দিয়ে দল পরিচালনা করলে আগামীতে দল চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্ হবে।
মধুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য এবং উপজেলার রায়পুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জাকির মিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী আব্দুর রহমানের ঘনিষ্ট ছিলেন তা স্বীকার করে বলেন, আমার আওয়ামী লীগে কোন পদ পদবী ছিলো না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সখ্যতা না করে আমি আমার চেয়ারম্যানের কোন কাজ করতে পারতাম না, তাদের সাথে না চরলে পেতাম না কোন উন্নয়নের বরাদ্দ । তাই আমাকে বাধ্য হয়েই আওয়ামী লীগের সাথে চলাফেরা করতে হতো। তিনি বলেন, আমি ১৯৯৭ সাল থেকে ১২ বছর মধুখালী যুবদলের সাধারন সম্পাদক ছিলাম। আওয়ামী লীগ সরকার আসার পরে কোনঠাসা হয়ে পরি। বাধ্য হয়েই আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলি। গত মাসের ১৯ তারিখে মধুখালীতে একটি নৌকা বাইচের অনুষ্ঠানে আমি ও নওপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান টিপু খন্দকার নাছির ভাইয়ের হাত দিয়ে আবারও বিএনপিতে যোগদান করি। আপনি আওয়ামীলীগে যোগদান না করলে পুনঃরায় বিএনপিতে ফুল দিয়ে যোগদানের বিষয়টি কেন করলেন এমন প্রশ্নের তিনি সদুত্তর দিতে পারেন নি। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের তৃণমূলের সম্মেলনে যোগদান করেন জাকির চেয়ারম্যান । আশুতোষ বিশ্বাসের মাধ্যমে চাপাদাহ বিলের নামে বেনামে শেয়ার নিয়েছেন। এখন এই আশুতোষকে খন্দকার নাসিরের মিটিং মিছিলে দেখা যায়। সাতৈর ইউনিয়নের যুবলীগ নেতা মো. এনামুলের বাড়ি একাধিকবার হামলাও ভাংচুর করে লুটপাট করেছে খন্দকার নাসিরের আস্থাভাজন বেড়াদি গ্রামের টিআই ও তার সমর্থকেরা। তার এই সব কুকর্মের কারনে এলাকায় গাইছো এবং মাইছো নাসির হিসাবে প্রতিপক্ষরা বলে বেড়ান।