স্টাফ রিপোর্টার : পুলিশের মতো বিধিবদ্ধ বাহিনীর চাকুরে হলেও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সমস্ত নিয়মকানুনকে ছাপিয়ে দলদাসের মতো ভূমিকায় নেমেছিলেন মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে গিয়ে আগ্রাসী ভূমিকায় ছিলেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এ উপকমিশনার।ইলতুৎমিশের খুঁটির জোর কোথায়।

বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পরও সদ্য তিনি অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে সবসময় মারমুখী থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ইলতুৎমিশ কীসের জোরে এখনো জিএমপিতে বহাল? এমন প্রশ্নও ঘুরেফিরে আসছে গাজীপুরের সচেতন মহলে।

কেবল জুলাই-আগস্টের আন্দোলনেই বিতর্কিত ভূমিকা নয়, ইলতুৎমিশের অতীত রেকর্ড নানা বিতর্কে ঘেরা। সাতক্ষীরায় বিএনপি নেতাকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি তিনি। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করাসহ নানা কাণ্ডেও বিতর্কিত।

জানা গেছে, ইলতুৎমিশ নিজেকে সবসময় আওয়ামী পরিবারের লোক পরিচয় দিতেন। জিএমপিতে সাবেক কমিশনার মোল্লা নজরুলের ক্যাশিয়ার হিসেবেও নিজেকে জাহির করতেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। এভাবে গত চার বছর বুক ফুলিয়ে বহু অপকর্মে জড়িয়েছেন।

সবশেষ জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীর মতো নিজেকে প্রকাশ করেছেন। যেখানেই আন্দোলনকারীদের দেখেছেন আগ্রাসী রূপ নিয়ে হাজির হয়েছেন। তবে সরকার পরিবর্তনের পরও পুলিশ কর্মকর্তা ইলতুৎমিশ এখনো বহল জিএমপিতে। এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে গাজীপুর সিটির বিভিন্ন মহলে।

হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে দোসর হিসেবে ইলতুৎমিশ আলেম-উলামেদের চরিত্র হরণ করেন। গাজীপুর মহানগরীর গাছা এলাকায় একটি ওয়াজ মাহফিলে দেওয়া বক্তব্যের কারণে আলোচিত ‘শিশু বক্তা’ রফিকুল ইসলাম মাদানীর বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৮ প্রপ্রিল জিএমপির গাছা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি এবং ১১ এপ্রিল বাসন থানায় আরো একটি মামলা দায়ের হয়।

এসব মামলায় গ্রেপ্তার হলে সাথে থাকা ৪টি মোবাইল ফোন জব্দ করে পুলিশ। ১২ এপ্রিল ডিসি ইলতুৎমিশ গাছা থানায় প্রেস বিফ্রিংয়ে জানান, রফিকুল ইসলাম মাদানীর মোবাইল ফোনে অশ্লীল ভিডিও এবং কুরুচিপূর্ণ পর্নোগ্রাফিতে ঠাসা। তিনি মিয়মিত এসব ভিডিও দেখতেন। পরে মামলায় পর্নোগ্রাফি ধারা যুক্ত করেন ডিসি ইলতুৎমিশ। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেন বলেও অভিযোগ করেন রফিকুল ইসলাম মাদানী।

বিসিএস ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ ২০২০ সালের জুন মাসে জিএমপিতে উপ-কমিশনার (ডিসি) হিসেবে যোগ দেন। পরে তাকে জিএমপির লোভনীয় টঙ্গী (দক্ষিণ) বিভাগের উপ-কমিশনার করা হয়।

জমি দখলে মদদ, মাদক ব্যবসায়ীদের লালনসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে ২০২১ সালের জুলাই মাসে তাকে ডিসি হেডকোয়ার্টার পদে ফিরিয়ে আনা হয়। গত তিনবছর ধরে তিনি ওই দায়িত্বে রয়েছেন।

জিএমপিতে যোগদানের আগে মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ ছিলেন সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। সাতক্ষীরায় তখন পুলিশ সুপার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. মোস্তাফিজুর রহমান।

২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কুচপুকুর গ্রামের বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবিরকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে ইলতুৎমিশ, সাবেক পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান ও সদর থানার সাবেক ওসি মহিদুল ইসলামসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে।

নিহত বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবিরের ভাই মো. আজগর আলী গত ২৫ আগষ্ট ওই মামলা করেন। সাতক্ষীরার আমলী আদালত-১ এর বিচারক মামলাটি এজাহার হিসেবে সদর থানার ওসিকে নির্দেশ দেন।

ইলতুৎমিশ জিএমপিতে আসার পর টঙ্গীর উপকমিশনার হয়ে সাতক্ষীরা সদর থানার তৎকালীন ওসি মহিদুল ইসলামকে বদলি করে টঙ্গীর পূবাইল থানায় নিয়ে আসেন। যোগ দিয়েই ওসি মহিদুল ও ডিসি ইলতুৎমিশ মিলে জমি দখল বাণিজ্য শুরু করেন। মহিদুল দায়িত্বে থাকার সময় পূবাইল একের পর এক ডাকাতি শুরু হয়। হয়ে এলাকা পরিণত হয় মাদকের অভয়ারণ্যে।

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকার খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবুল মজিদের খিলগাঁও মৌজায় ৮ বিঘা জমি ছিল। তিনি পর্যায়ক্রমে প্রায় সব জমি বিক্রি করে দখল বুঝিয়ে দেন। পরে ইলতৎমিশের সঙ্গে মিলে বিক্রি করা জমি উদ্ধারের প্রক্রিয়া করেন। ইলতুৎমিশ ওসি মহিদুলকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে আবদুল মজিদের জমি ছেড়ে দিতে হুমকি দেন। নইলে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তারের হুমকি দেন।

গাজীপুরের একজন পরিবহন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইলতুৎমিশ ছিলেন জিএমপির সাবেক কমিশনার বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা মোল্লা নজরুল ইসলামের চাঁদার ক্যাশিয়ার। গাজীপুরের তাকওয়া পরিবহন বাস কোম্পানির কাছে মোল্লা নজরুলের হয়ে ৮০ লাখ টাকার বেশি চাঁদা দাবি করেন তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার দেলোয়ার হোসেন ও ইলতুৎমিশ।

তিনি আরও জানান, পরে তাকওয়া পরিবহন কোম্পানির পক্ষ থেকে ইলতুৎমিশের কাছে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। একদিন পর তিনি সেই টাকা ফেরত দিয়ে পুরো ৮০ লাখ টাকাই দিতে হবে বলে জানান। তার চাহিদা মাফিক টাকা দিতে না পারায় ২৫টি বাস ৭ মাস আটকে রাখে পুলিশ। চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয় বহু শ্রমিককে।

জানা গেছে, ইলতুৎমিশ টঙ্গীর ডিসি থাকার সময় টঙ্গী পূর্ব থানার সেকেন্ড অফিসার আশিক রোনাল্ডসহ তিন এসআই দত্তপাড়া এলাকার একটি বাসা থেকে বিপুল পরিমান ফেন্সিডিল উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় কোনো আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে উদ্ধার করা ফেন্সিডিল গোপন বিক্রি করে দেন।

অভিযোগ রয়েছে, উল্টো ওই বাড়ির মালিকের কাছ থেকে আদায় করেন মোটা অংকের টাকা। সেসময় গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে তিন এসআইকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কমিটিকে প্রভাবিত করে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগও উঠে তার বিরুদ্ধে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ২১ জুলাই গাছা থানার বোর্ড বাজারে গুলি-টিয়ারসেলে মারা যায় ৯ জন। ওই সময় বোর্ড বাজার ও গাজীপুরা এলাকায় আন্দোলকারী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে ইলতুৎমিশ নেতৃত্ব দেন। সেসময় ভয়াবহ রকম ভাবে আগ্রাসী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা ইলতুৎমিশ।

তার বিরুদ্ধে এতসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি জিএমপির বিতর্কিত এ কর্মকর্তার।