বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আমরা দল, ধর্ম ও গোষ্ঠির ভিত্তিতে জাতিকে আর বিভক্ত হতে দিবনা।জাতিকে ভাগ করার সুযোগ আর কাউকে দিব না। যতো বিভাজন রেখা তৈরী করা হয়েছিল তা আমরা পায়ের নীচে ফেলে দিয়েছি। আমরা বৈষম্যহীন ও শোষনমুক্ত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। জনগণের টাকায় কেনা বুলেট জনগণের বুকে ছোঁড়ার দুঃসাহস করবে এমন সন্ত্রাসী সরকার আমরা আর দেখতে চাইনা। এজন্য ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি হাতকে এক করতে হবে। বিশ্বকে জানান দিতে হবে দেশ ও জাতির স্বার্থে আমাদের মধ্যে কোন বিভাজন নাই।আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে জানিয়ে দিতে চাই, তোমরা অতীতে যা করেছো এ জাতি আর তোমাদেরকে তা করতে দেবে না। আমরা জানিয়ে দিব এখন থেকে বাংলাদেশের মানুষ কালোকে কালো এবং সাদাকে সাদা বলবে। আমরা চাই এমন একটা দেশ হবে, যে দেশে কোন বৈষম্য থাকবে না।
তিনি বলেন, ক্ষমতায় বসে দেশের মালিক বনে গেলে কি পরিণতি হয় তা আমরা দেখেছি। জাতির সঙ্গে গাদ্দারি করলে যে পরিণতি হয় তা দেখে আমাদের সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে। অতীত থেকে যদি শিক্ষা গ্রহণ করি তাহলে আগামীতে আর কোন স্বৈরাচারের জন্ম হবেনা।জাতিকে তারাই ভাগ করে যারা জাতির দুশমন।কে কোন ধর্ম পালন করবে কিংবা কোন দল করবে সেটা তার নিজের পছন্দ। কিন্তু দেশের ও জনগণের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। দেশে ও বিদেশে জানান দিতে হবে যে, দেশ এবং জাতির স্বার্থে আমাদের মাঝে কোন বিভাজন নেই। এরকম একটা ঐক্যবদ্ধ জাতিকে কেউ আর দমিয়ে রাখতে পারবেনা।

জামায়াতে আমীর আরো বলেন, আমরা আদালতে ন্যায়ভ্রষ্ট বিচারক আর দেখতে চাইনা। আমরা কোনো শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদকে আদালতের বিচারক হতে দেখতে চাই না। কোনো দুর্বৃত্তকে আদালতের চেয়ারে দেখতে চাই না। নীতি নৈতিকতা ও বাস্তবতার ভিত্তিতে বিচার করবে, সেই রকম বিচারক দেখতে চাই। একজন সরকারি কর্মকর্তা রাষ্ট্রের সেবক, তিনি দল গোষ্ঠি বা ব্যাক্তির সেবক না। আমরা এমন কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আগামীতে দেখতে চাই না যাদেরকে বাধ্য করা হবে রাষ্ট্র ও জনগন বাদ দিয়ে গোষ্ঠির পূজা করার জন্য।আমাদের এমন একটা সমাজ প্রয়োজন যে সমাজে শিক্ষিত মানুষগুলো কলমের খোঁচায় হাজার হাজার কোটি টাকা জাতির কাছ থেকে লুটপাট করবে না। যারা এতোদিন অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা করেছে, অন্যায় অবিচার করেছে, জনগণের অর্থ সম্পদ লুট করেছে তাদেরও ন্যায় বিচার চাই। তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। যাদের ফাঁসি হওয়া উচিত তাদের ফাঁসি হতে হবে। আর যাদের যাবজ্জীবন জেল হওয়া উচিৎ তাদের জেল এবং যারা খালাস হওয়ার তাদের খালাস হতে হবে। আমরা সকল অন্যায় অবিচারের শাস্তি হোক সেটাই চাই।এমন একটা দেশ আমাদের সকলের কামনা। সেই দেশটা আমাদেরকেই গড়তে হবে, ইনশাল্লাহ।বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তিনি শুক্রবার গাজীপুর শহরের ভাওয়াল রাজবাড়ী মাঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে শহীদদের পরিবারের সঙ্গে মতবিনিময় ও সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতাকালে এসব কথা বলেন। গাজীপুর মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীনের সভাপতিত্বে ও মহানগর সেক্রেটারি আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুকের সঞ্চালনায় সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ, জামায়াতের ঢাকা উত্তর অঞ্চল টিম সদস্য ও গাজীপুর জেলার সাবেক আমীর আবুল হাসেম খান, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ড. খলিলুর রহমান মাদানী,গাজীপুর জেলা জামায়াতের আমীর ড. জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমীর মোঃ খায়রুল হাসান, মহানগরজামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি মোঃ হোসেন আলী, মোঃ আফজাল হোসেন, শিবিরের সাবেক সভাপতি ও গাজীপুর মহানগর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আইউবী, শিবিরের গাজীপুর মহানগর সভাপতি মোঃ আবু হানিফ প্রমুখ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছর ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতন চালানো হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর উপর। বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোজাহিদসহ ১১ জন শীর্ষ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। কোরআনের পাখি আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর মর্মান্তিক মৃত্যু কোন অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায়না। জুলুম করে এসব বিচারিক হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে। আমরা শুধু আমাদের নেতা কর্মীদের হত্যার বিচার নয় সকল দলের ও নিরীহ মানুষের হত্যার বিচার দেখতে চাই। যারা হত্যার সাথে জড়িত ছিল, যারা এসব হত্যারপরিকল্পনাকারী, মাস্টারমাইন্ড, হত্যা বাস্তবায়নকারী, আদালতে বসে যারা দুষ্ট রায় দিয়েছেন, মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছেন, তদন্ত করতে গিয়ে যারা নাটক সাজিয়েছেনএবং বিভিন্নভাবেসহযোগিতা করেছেন তাদের কেউ যেন সেই অপরাধ থেকে রেহাই না পায়, তাদেরও বিচার করতে হবে।তারা গোটা জাতিকে হত্যা করতে চেয়েছিল। বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস দেশ প্রেমিক অফিসারদেরকে ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাসের মাথায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিডিআর বাহিনীকে ধ্বংস করা হয়েছে। নিরীহ মানুষ যারা জেলে বন্দি আছে আমরা তাদের সবার মুক্তি চাই।

জামায়াতে আমীর বলেন, আমরা বলেছিলাম আমরা প্রতিশোধ নিব না, আইন হাতে তুলে নিব না, আমরা আমাদের কথা রেখেছি। আমাদের সহকর্মীরা চরম ধৈর্য ধারণ করেছেন। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে আলেম ওলামাদের সঙ্গে কি আচরণটা করা হয়েছে তা সবাই জানেন। রাতের অন্ধকারে চতুর্দিকে আলো নিভিয়ে তারা ব্রাশ ফায়ার করে কতজনকে যে হত্যা করেছে আল্লাহ ভালো জানেন। তাদের লাশটিও পাওয়া যায়নি। দুষ্ট সরকারের কয়েক মন্ত্রী ২৪ এর পতনের মাত্র চারিদন আগে বলেছেন বাড়াবাড়ি করবেন না, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর ভুলে যাবেন না। ওইদিন রাত ১২ টার পর আমরা সব কয়টাকে সাফ করে দিয়েছি। এবারেও সাফ করে দিব।

শহীদ পরিবারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ’২৪ এর আন্দোলনে শহীদ ও আহতরা আমাদের অহংকার। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা আমাদেরকে দিতে হবে। এই শহীদরা জাতির সম্পদ, ইজ্জতের চুড়ান্ত সীমায় আমরা তাদের রাখতে চাই, দেখতে চাই।আন্দোলনে শহীদদের আমরা দলীয় কোন পরিচয়ে দেখতে চাইনা। সকল শহীদ ও আহত ভাইয়েরা আমাদের সকলের আপনজন। তাদের পরিবারের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। যারা শহীদ হয়েছেন তারা চাকরি পাওয়ার জন্য বা কারো সহযোগীতার জন্য লড়াই করেন নাই। তারা আমাদের অহংকার, মর্যাদার এবং সম্মানের পাত্র। তারা জাতিকে সম্মানীত করার জন্য নি:স্বার্থ লড়াই করেছে।তারা দেশের জন্য করেছে।এখন আমাদের উচিৎ তাদের জন্য কিছু করা।জাতির দায়িত্ব তাদের পরিবারকে সম্মাণীত করা। এটা করতে হবে, এর বিকল্প নেই। সরকারের কাছে দাবি জানাবো তাদের সঠিক স্বীকৃতিটা যেন দেওয়া হয়। প্রতিটা শহীদ পরিবার থেকে কমপক্ষে একজনকে সম্মানজনক সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। লড়াই করে যারা আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন তাদেরও চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যেন আজীবন কারো করুনার পাত্র হয়ে না থাকে।তিনি আগামীতে দেশ গঠনে আপামর জনতার সহযোগিতা চেয়ে নেতাকর্মী ও দেশবাসীকে প্রত্যেক শহীদ এবং আহত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান।

তিনি বলেন, আমরা এমন একটি সমাজ চাই যেখানে ব্যবসায়ীরা নির্ভয়ে তাদের ব্যবসা করবে কিন্তু কোন দুর্বৃত্ত তাদের কাছে চাঁদা চাইবেনা। যদি তাই হয় তাহলে বাজারে ৩০ টাকার পিঁয়াজ আর ৩০০ টাকা হবেনা। সামাজিক নিরাপত্তা এমন হবে যে, সমাজের প্রতিটা নাগরিক নিরাপদে তার ঘরে ঘুমাতে পারবে। স্বাস্থ্য সেবাসহ প্রতিটা শিশু তার প্রাপ্য সকল অধিকার যাতে রাষ্ট্রের কাছ থেকে পায় সেই রকম একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে মতলববাজরা মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে রাখে। উদ্যেক্তা এবং মালিক যদি না থাকে শ্রমিকরা কোথায় কাজ করবে। শিল্প যদি না বাঁচে কর্মসংস্থান কোথায় হবে।আমরা চাই ব্যবসায়ীরা তার জায়গায় বসে ব্যবসা করুক, কোন দুর্বৃত্তের সাহস হবে না তার কাছে চাঁদা চাওয়ার। বাজারে স্বস্তি থাকবে, সহনীয় দ্রব্যমূল্য থাকবে, যাতে প্রতিটি মানুষ তার সামর্থ অনুযায়ী স্বস্তির সাথে বসবাস করতে পারে। সামজিক নিরাপত্তা এমন হবে, সে ঘরের মধ্যে দরজা খোলা বা বন্ধ হোক রাতের বেলা শান্তিতে ঘুমাবে, কোন দুর্বৃত্ত তার সম্পদ বা ইজ্জত লুটে নেওয়ার সাহস করবে না। আমরা এমন একটা সমাজ চাই।

অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমীর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও আহত পরিবারের খোঁজ খবর নেন। এসময় ২৬ জন শহীদ পরিবারের সদস্যদের হাতে ২ লাখ টাকা করে মোট ৫২ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান প্রদান করেন। এর আগে সকাল থেকে জামায়াতের আমীরের আগমন ঘিরে জেলা ও মহানগরের বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মিছিল নিয়ে রাজবাড়ী মাঠে উপস্থিত হন।