হিজবুল্লাহর সদস্যেদের ব্যবহার করা কয়েক হাজার তারহীন যোগাযোগ যন্ত্র পেজার ও ওয়াকিটকিতে একযোগে মঙ্গল ও বুধবার বিস্ফোরণে ৩৭ জন নিহত ও তিন হাজার জনের আহত এবং শুক্রবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইব্রাহিম আকিল নামে এক সিনিয়র কমান্ডার নিহতের ঘটনায় বেশ বেকায়দায় হিজবুল্লাহ। এসব ঘটনায় ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে সর্বাত্মক যুদ্ধের যে আশঙ্কা দেখা দেয় তার পারদ কিছুটা আরও বাড়ল। ইসরায়েলের সবচেয়ে গভীর এলাকায় বিমান ঘাঁটি লক্ষ্য করে শনিবার রাতে রকেট হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। এ হামলার হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে আজ রোববার মধ্যরাতের পর উত্তর ইসরায়েলজুড়ে সতর্কতামূলক সাইরেন বাজানো হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে এটাই সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রথম রকেট হামলা। উত্তর ইসরায়েলের হাইফা শহরের পূর্ব দিকের রামাত ডেভিড বিমান ঘাঁটি লক্ষ্য করে কয়েক ডজন রকেট হামলা চালানো হয়েছে।

হামলার কথা নিশ্চিত করে হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, ফাদিয়া-১ ও ফাদিয়া-২ রকেট ছুড়েছে তারা। গত কয়েক মাসে তারা ইসরায়েলের দিকে যেসব রকেট ছুড়েছিল তা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার সোভিয়েত রাশিয়ার তৈরি কাতিউশা রকেট।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিজবুল্লাহর দাবি অনুযায়ী- ২০০৬ সালের যুদ্ধের পর এবারই প্রথম হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের ভেতরে ২০ কিলোমিটারের বেশি দূর পর্যন্ত পৌঁছেছে। এবারই তারা প্রথমবারের মতো ৪৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করল। হাইফা শহরের পূর্ব দিকের রামাত ডেভিড বিমান ঘাঁটিসহ বিভিন্ন এলাকায় রকেট জব্দ করার কথা শোনা গেছে।

লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তথ্যমতে, ইব্রাহিম আকিলের ওপর ওই হামলায় আরও ১২ জন নিহত ও ৬৬ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে আকিল ছাড়া বাকি ১১ জনের মধ্যে ১০ জনই হিজবুল্লাহর বিভিন্ন পর্যায়ের কমান্ডার বলে দাবি করেছে ইসরায়েল।

আল জাজিরা জানায়, নিহত আকিল হিজবুল্লাহর অভিজাত ‘রাদওয়ান বাহিনীর’ সিনিয়র নেতা ছিলেন। হামলার সময় তিনি একটি বৈঠকে ছিলেন। হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের বৈঠকটি চলছিল। ইসরায়েলের হামলায় দুইটি ভবন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন লেবাননের বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।

লেবাননে নজিরবিহীন পেজার ও ওয়াকিটকি হামলার জবাবে ইসরায়েলে কঠিন প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দিয়েছে দেশটির সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার এক টেলিভিশন ভাষণে সংগঠনটির শীর্ষ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ বলেন, ইসরায়েল সব সীমা লঙ্ঘন করেছে। এ কারণে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।

লেবাননজুড়ে চালানো নজিরবিহীন হামলায় ৩৭ জন নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে দেওয়া প্রথম টেলিভিশন ভাষণে হিজবুল্লাহ নেতা বলেন, এটা ছিল ‘মানবিকতা ও নিরাপত্তার ওপর বড় আঘাত।’ গত মঙ্গল ও বুধবার চালানো এসব হামলায় ৩ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন। হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে এটাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ ও ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ বলে মন্তব্য করেন নাসরাল্লাহ। তিনি বলেন, এ হামলা লেবাননের মানুষ ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে; দেশের ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা।

হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা জানান, গত ৮ অক্টোবরের পর ইসরায়েল তাদের সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্যকে উত্তরাঞ্চল থেকে সরিয়ে নেয়নি। যেসব ইসরায়েলিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাদের আর নিজ নিজ বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হবে না। ডিভাইস বিস্ফোরণে যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক বলে জানান তিনি। এগুলো হাসপাতাল, বাজার, বাড়িঘরে বিস্ফোরিত হয়েছে। এ সময় তিনি লেবাননে হামলার ঘটনাকে ‘বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করে ‘কঠিন পাল্টা আঘাত ও উপযুক্ত শাস্তি’র হুঁশিয়ারি দেন।

এ প্রক্ষাপটে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা হয়েছে। ইসরায়েলের আর্মি রেডিও জানায়, শুক্রবার এক দিনে হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরায়েলে ১৫০টির বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছে। এতে অন্তত একজন আহত হয়েছেন। ইসরায়েলও লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এতে হিজবুল্লাহর এক সদস্য নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের বলছে, তারা হিজবুল্লাহর শতাধিক রকেট উৎক্ষেপক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। লেবাননের কর্মকর্তারা এটাকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় বোমা হামলা বলছেন।

উত্তেজনাকর এই পরিস্থিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি এটাকে ‘লেবাননের সার্বভৌমত্বের স্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে বর্ণনা করেছেন।