সংঘাতের পর থেকে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি জেলাজুড়ে নেমে এসেছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কখন, কোথায় কী হবে- এমন আশঙ্কায় শঙ্কিত পাহাড়ের এই জনপদের শান্তিপ্রিয় মানুষ। জেলা জুড়ে অধিকাংশ দোকানপাট শপিংমল এখনো খোলেননি ব্যবসায়ীরা। বন্ধ রয়েছে যানবাহন চলাচল। খাগড়াছড়িতে এখনো ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। শহরের মোড়ে মোড়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি দিচ্ছে টহল। পাহাড়ি এলাকা থেকে শহরমুখী হতে দেখা গেছে জেলার বাসিন্দাদের।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ বাসিন্দাদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। অপ্রয়োজনে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। আর কেউ বের হলেও সন্ধ্যার আগে ফিরছেন।

তবে পুলিশ বলছে, লোকজনের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।

বৃহস্পতিবার পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের জেরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে চার জন নিহত, অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবিতে গতকাল শুক্রবার ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার’ ব্যানারে ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দেন। এই কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন নামের একটি সংগঠন। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (ইউপিডিএফ) অবরোধে সমর্থন জানায়।

অবরোধের প্রথম দিন আজ শনিবার খাগড়াছড়িতে যান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে খাগড়াছড়ির সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি ও মাটিরাঙাসহ আন্তঃউপজেলাগুলোতে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অবরোধের সমর্থনে শনিবার সকালে খাগড়াছড়ি সাজেক সড়ক, পানছড়ি ও রামগড় সড়কে টায়ার জ্বালায় অবরোধকারীরা। তবে কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।

আতঙ্ক খাগড়াছড়ি জুড়ে

চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার একমাত্র বাস স্টেশন হচ্ছে অক্সিজেন এলাকা। একই রুটে যাওয়া যায় হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি উপজেলায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দূরপাল্লার বাস হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি উপজেলা পর্যন্ত চলাচল করছে। এরপর থেকে কোনো বাসের দেখা মেলেনি। ফটিকছড়ির সঙ্গে লাগোয়া খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলা। সেখান থেকে চারদিকে সুনসান নীরবতার দেখা মেলে। মাঝেমধ্যে দুই একটি মোটরসাইকেল দেখা যায়। মাটিরাঙ্গায় এসেও একই পরিস্থিতি। কিছু দোকান খোলা থাকলেও অন্য দোকানগুলোতে তালা ঝুলছে। যে কয়েকটি দোকান খোলা রয়েছে তার অধিকাংশই ক্রেতাশূন্য।

সেখানকার দোকানি মো. হাছান আমাদের সময়কে বলেন, পাহাড়ি- বাঙালি সংঘাতের পর থেকে মানুষ তেমন রাস্তায় বের হচ্ছে না। যদিও এই এলাকাটি শান্ত। তবুও একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

খাগড়াছড়ি শহরে ডুকে দেখা গেছে আরো পিনপতন নীরবতা। দুই একটি টমটম দেখা মিললেও সেখানে দেখা মেলেনি কোনো যাত্রীর। শহরের বিভিন্ন রাস্তার মুখে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ-বিজিবি, সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়া শহরের শাপলা চত্বর, পৌরসভা এলাকা, হ্যাপির মোড়, নিউ মার্কেট, স্টেডিয়াম এলাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবস্থান দেখা গেছে।

সংঘাতের সূত্রপাত খাগড়াছড়ির দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে গিয়ে দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি ও বাঙালি ব্যবসায়ীদের জটলা বেধে আলোচনা করছেন। অনেকে পুড়ে যাওয়া দোকানে মালামাল দেখছেন, যদি আগুন থেকে কিছু বেঁচে থাকে সেগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন লারমা স্কয়ার ক্রেতা-বিক্রেতায় ঠাসা থাকলেও বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর থেকে সেখানে ভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শুক্রবার থেকে লারমা স্কয়ার এলাকায় মানুষের খুব একটা দেখা মিলেনি। গতকাল শনিবার সেখানে বড় বাজার বসার কথা ছিল। তবে পুড়ে যাওয়া দোকানি ছাড়া তেমন কেউই সেখানে নেই।

লারমা স্কয়ারের লাগোয়া বোয়ালখালি বাজারে কিছু কিছু দোকানপাট খোলা থাকলেও অধিকাংশ দোকান বন্ধ দেখা গেছে। মানুষের চোখ-মুখ দেখে একটা চাপা আতঙ্ক লক্ষ্য করা গেছে। পরিস্থিতি একটু থমথমেও।

খাগড়াছড়ি শহর থেকে দীঘিনালা যাওয়ার পথে আট মাইল, নয় মাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় অধিকাংশ দোকানপাটই বন্ধ দেখা গেছে। লারমা স্কয়ারজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংবাদকর্মী ও জনপ্রতিনিধির ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে।

বোয়ালখালী বাজারের বিসমিল্লাহ ভাতঘরের মালিক সিরাজুর ইসলাম বলেন, ‘দীঘিনালার সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে বোয়ালখালী বাজার। প্রতিদিন ১০-১২ হাজার মানুষ এখানে আসা যাওয়া করে। আজকে বাজার ছিল এখানে, কিন্তু মানুষজন নেই। বেচাবিক্রিও নেই। দোকান দিয়ে সংসার চলে। অনেকে দোকান না খুললে আমি খুলেছি। সন্ধ্যার আগে বন্ধ করে দেব।’

স্থানীয় বাসিন্দা রুমেল চাকমা বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই। হানাহানি রক্তপাত পাহাড় দেখতে চাই না। পাহাড়ি বাঙালি মিলেমিশে আমরা ব্যবসা করছি, শান্তিতে থাকছি। এগুলো সন্ত্রাসীদের সহ্য হচ্ছে না। তাই সম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে চাচ্ছে।’