বিশ বছর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার ঘটনায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন এবং তাদের করা আপিলের ওপর শুনানি হাইকোর্টে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। গত সপ্তাহে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চটি পুনর্গঠিত হয়। এরপর গত রবিবার মামলাটি বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহ সমন্বয়ে গঠিত পুনর্গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে উঠলেও সেদিন শুনানি হয়নি।

আগামী ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ অক্টোবার পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের অবকাশকালীন ছুটি। এর দুই সপ্তাহ পর এ মামলাটি আদালতের একই বেঞ্চে উঠবে বলে আদালত সূত্রে জানা যায়। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানির জন্য অক্টোবরের শেষদিকে সময় রেখেছেন আদালত। গত রবিবার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নৃশংস ওই হত্যাকা-ের বিচার শেষে ৬ বছর আগে রায় হলেও ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল শুনানি শুরু হয়। বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল।

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। এরপর নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ১১ আগস্ট দায়িত্বগ্রহণ করেন। পরে হাইকোর্ট বিভাগের ৫১টি বেঞ্চ পুনর্গঠন করেন তিনি।

গতকাল মঙ্গলবার অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ আমাদের সময়কে বলেন, মামলাটি বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চে এতদিন শুনানি হয়েছে। এরপর এ বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি পরিবর্তন হয়েছেন। গত তারিখে আমি আদালতকে বলেছি- অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে আমি এ মামলা শুনানিতে অংশ নিতে পারছি না। এ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে আরেকজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হবে। এদিকে নতুন বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতিও এ মামলার শুনানির শুরুতে ছিলেন না বলে শেষদিকে শুনতে অপারগতা জানিয়েছেন। এ অবস্থায় অক্টোবরের শেষদিকে মামলাটি আবার আদালতে উঠবে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির আমাদের সময়কে বলেন, মামলাটির শুনানি শেষ পর্যায়ে এসে বেঞ্চ পুনর্গঠিত হয়। এ আদালতের কনিষ্ঠ বিচারপতি শুনতে অপারগতা জানিয়ে মামলাটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানোর কথা বলেছেন। এখন অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে এ বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। সেদিন মুফতি হান্নানের হরকাতুল জিহাদের সদস্যরা এই হামলা চালায়। কয়েক বছর আগে অন্য একটি মামলায় মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়। এদিকে হামলার ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বহুল আলোচিত এ মামলার রায় দেয় ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ-। এ ছাড়া ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা হওয়ার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের মাঝখানে একটি ট্রাক এনে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ। শোভাযাত্রার আগে সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। বক্তৃতা শেষ করে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সময় ঘটে পরপর দুটি বিস্ফোরণ। এরপর সামান্য বিরতি দিয়ে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ শুরু হয়। তারই মধ্যে শোনা যায় গুলির আওয়াজ।

ওই হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ জন আহত হন। মঞ্চে উপস্থিত নেতাকর্মীরা বিস্ফোরণে মধ্যে মানববর্ম তৈরি করায় সেদিন অল্পের জন্য রক্ষা পান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।

এদিকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিনে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ নানা কর্মসূচি করে আসছিল। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগে বিপর্যয় নেমে আসে। অধিকাংশ কেন্দ্রীয়, জেলা, মহানগর নেতা গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ফলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিবস উপলক্ষে আজ বুধবার আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি পালিত হবে কিনা তা জানা যায়নি।