গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লিফটে আটকে পড়ে এক নারী রোগীর মৃত্যু হয়েছে। লিফটের ভেতরে আটকে পড়া রোগী ও তার স্বজনদের উদ্ধারের জন্য আকুতি জানালেও লিফট অপারেটররা উদ্ধার না করে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। পরে জাতীয় জরুরী সেবা নম্বরের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট আটকে থাকার পর নিহতের লাশসহ তার স্বজনদের ওই লিফট থেকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। রবিবার সকালে হাসপাতালের ৩ নম্বর লিফটে এ ঘটনাটি ঘটেছে। এ ঘটনা তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দু’টি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠণ করেছে।
নিহতের নাম- মমতাজ বেগম (৫০)। তিনি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের বাড়িগাঁও গ্রামের শারফুদ্দিন বিএসসি’র স্ত্রী।
হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা: কামরুল ইসলাম আরো বলেন, ধারনা করা হচ্ছে কয়েকদিন আগে মমতাজের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তিনি রবিবার (১২ মে) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ওই অবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে আসলে তাকে ১১তলার মেডিসিন বিভাগের মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। পরে তার শারিরীক পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর হার্ট অ্যাটাকের বিষয়টি ধরা পড়ে। তার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে রোগীকে হাসপাতালের চতুর্থ তলায় কার্ডিওলজি বিভাগের সিসিইউতে রেফার্ড করা হয়। পরে তাকে ওয়ার্ড থেকে সিসিইউতে নেওয়ার জন্য লিফটে তোলা হলে অজ্ঞাত কারণে লিফ্ট বন্ধ হয়ে যায়। লিফ্টে প্রায় ৪০ মিনিট আটকে থাকার পর লিফট থেকে তাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
নিহতের ভাগ্নে খন্দকার শাহাদত হোসেন সেলিম জানান, তার মামী মমতাজ বেগম শ্বাস কষ্ট ও হৃদরোগ নিয়ে রবিবার সকাল ৬টার দিকে ওই হাসপাতালের ১১ তলার মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন। পরে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে একই ভবনের ৪র্থ তলায় থাকা কার্ডিলজি বিভাগে ট্রান্সফার করেন। মামী হাটা চলা করতে পারলেও তখন তাকে দ্রুত হৃদরোগ বিভাগে নেয়ার জন্য ট্রলিতে উঠানো হয়। পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মমতাজ বেগম, তার ছেলে আব্দুল মান্নান ও মেয়ে শারমিনসহ আমরা হাসপাতালের ৩ নং লিফটে উঠি। কিন্তু লিফটি হাসপাতালের ৯ম ও ১০ তলা মাঝমাঝি থাকা অবস্থায় লিফটি হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায়। তখন আমি লিফটে থাকা মোবাইল নম্বরে একাধিক ব্যাক্তিকে বার বার ফোন করলেও তারা কোন কর্ণপাত করেনি। উপরন্তু বার বার ফোন করায় তারা বিরক্ত হয়ে আমাদের গালিগালাজ করেন। আটকে থাকার প্রায় ৩০ মিনিট পর এক পর্যায়ে কয়েকজন অপারেটর গিয়ে লিফটের দরজা কিছুটা ফাঁক করে আবার দরজা বন্ধ কওে দেয়। তারা আটকেপড়াদের উদ্ধারের কোন উদ্যোগ না নিয়ে সেখান থেকে তারা চলে যায়। এমতাবস্থায় রোগী ছটফট করতে থাকলে আবারো অপারেটরদের ও জাতীয় জরুরী সেবা নম্বর ৯৯৯ এ ফোন করি। এসময় অনেক কষ্টে আমরা তিনজন বেরিয়ে আসতে পারলেও মমতাজ বেগমকে বের করা সম্ভব হয়নি। পরে ৯৯৯ নম্বরে পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু ততক্ষণে লিফটের ভেতরই মমতাজ বেগম শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। পরে জয়দেবপুর ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা দরজা খুলে মমতাজ বেগমের লাশ উদ্ধার করেছে। যদি সঠিক সময়ে তাকে উদ্ধার করা হতো তাহলে হয়তো তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হতো। এসময় তিনি এ ঘটনার জন্য লিফট অপারেটরদের দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ করেন।
নিহতের স্বামী অভিযোগ করে বলেন, লিফট নামার সময় আমি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে লিফটের বাইরে ছিলাম। লিফট আটকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে আমি একবার তিন তলায় (প্রশাসনিক ভবন), একবার পাঁচ তলায়, একবার সাত তলায়, একবার ১১ তলায় কর্মকর্তার নিকট দৌড়াদৌড়ি করি রোগীকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু তাদের কাছে আবেদন-নিবেদন করলেও তারা আমার আবেদনে সাড়া দেন নাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে দ্রুত উদ্ধার করে চিকিৎসা দিলে আমার স্ত্রী হয়তো বেঁচে যেতো। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে তিনি এ ঘটনার জন্য সঠিক তদন্ত করে বিচার দাবী করেন।
নিহতের মেয়ে শারমিন বলেন, আমি মা’র সঙ্গে লিফটে ছিলাম। ৯ তলার মাঝামাঝি উঠলে লিফটে আকস্মিক বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের সঙ্গে থাকা মামা, ভাইসহ আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এসময় আমরা প্রত্যেক লিফটম্যানকে ফোন দিলে তারা গাফিলতি করে এবং আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে আমরা ৯৯৯-এ ফোন দেই। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে উদ্ধার করে। লিফটম্যানদের গাফিলতির কারণে আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে।
শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনাটি দু:খজনক। চিকিৎসার অভাবে রোগী মারা যায়নি। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে হাসপাতালে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে লিফটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এতে হাসপাতালের ৯ম তলায় লিফটি থেমে গেলে সেখানেই লিফটের ভিতরে আটকা পড়েন রোগী মমতাজ ও তার কয়েক স্বজন। আটকে পড়া ওই লিফটের ভিতরে রোগী মমতাজ মারা গেছেন। এ ঘটনা তদন্তে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৩দিনের মধ্যে লিফট আটকে যাওয়া ও রোগী মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তের পর প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। এ ঘটনায় কারো গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠণ করা হয়েছে। বিষয়টি সরেজমিনে খতিয়ে দেখে দায়-দায়িত্ব নিরূপনসহ সোমবারের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মতিউর রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ঘটনাটির ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৪ মে রাত পৌনে ১১টার দিকে একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী জিল্লুর রহমান (৭০) হাসপাতালের ১২তলার ভেতরের দেয়াল ও মেঝের মধ্যে থাকা ফাঁকা স্থান দিয়ে ১০ তলায় পড়ে গিয়ে মারা যান। তিনি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের কাসেম আলীর ছেলে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এবার লিফটে আটকে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলা ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও উপযুক্ত শাস্তির দাবী করেছেন তারা।