মা আর ছোট ভাইয়ের সামনেই নিউইয়র্কে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে বাংলাদেশী তরুণ উইন রোজারিওকে (১৯)।
মঙ্গলবার (২৭ মার্চ) স্থানীয় সময় বেলা ১টা ৪০ মিনিটের দিকে ওজোনপার্ক ১০৩ স্ট্রিট, ১০১ এভিনিউয়ের বাসায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছে গোটা কম্যুনিটি।
নিহত উইনের মা ইভা কোস্টা (৪৯) গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, তার ছেলে পুলিশের দিকে কাঁচি হাতে ধাওয়া করেনি। পুলিশের বডি ক্যামেরা পরীক্ষা করলেই তা স্পষ্ট হবে।
অন্যদিকে, সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ওই বাসা থেকে উইন হটলাইনে (৯১১) কল করে দ্রুত পুলিশের সহায়তা চায়। দুই মিনিটের মধ্যেই টহল পুলিশ ওই বাসায় যায়। পুলিশের চিফ অব পেট্রল জনছেল জানান, সেখানে পৌঁছানোর পর উইনের মানসিক সংকটের চরম অবনতি ঘটে। পুলিশ চেষ্টা করছিল তাকে নিয়ন্ত্রণে এনে নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে। কিন্তু উইন হাতের কাছে একটি ড্রয়ার থেকে (সম্ভবত কিচেন রুমে) ধারালো কাঁচি বের করে পুলিশের দিকে ধেয়ে আসে।
চিফ অব পেট্রল আরও উল্লেখ করেন, উইনকে শান্ত করতে ব্যর্থ হলে কর্তব্যরত দুই পুলিশ অফিসারই প্রথমে তাকে থামানোর চেষ্টা করেন। এতে সে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে আরও কয়েকটি কাঁচি হাতে নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করেন। সে সময়ই পুলিশ তাকে গুলি করতে বাধ্য হয়। গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে অ্যাম্বুলেন্সে নিকটস্থ জ্যামাইকা হাসপাতালে নেওয়ার পর জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের পক্ষ থেকে আরও দাবি করা হয়, উইনের ছোট ভাই উৎস রোজারিও (১৭) তাদের জানিয়েছে, উইন মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না। কদিন আগেও নাকি চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন।
পুলিশ আরও দাবি করেছে, উইনকে ঠেকাতে পুলিশ অফিসারদ্বয় টেজার (আত্মরক্ষার প্রাথমিক অস্ত্র) প্রয়োগের চেষ্টা করলে তার মা সেটি প্রতিহত করেন। অবশ্য পুলিশের এ দাবি সত্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন উইনের মা ইভা কোস্টা।
তিনি জানান, উইন পুলিশের কাছে ধরা দিতে চায়নি। সে তাকে জড়িয়ে ধরে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল।
ইভা কোস্টা বলেন, তার ছেলেকে অন্যায় ভাবে হত্যা করা হলো। তিনি এর বিচার দাবি করেছেন।
ইভা বলেন, উইন মার্কিন সেনাবাহিনীতে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। ইন্টারভিউতে টিকে গেছেন। মানসিকভাবে সে সুস্থ না থাকলে ইন্টারভিউতে টিকলো কীভাবে?
উল্লেখ্য, উইনের বাবা ফ্রান্সিস রোজারিও (৫২) জেএফকে এয়ারপোর্টে কাজ করেন। এই ঘটনার সময় তিনি সেখানেই ছিলেন। সংবাদ পেয়ে দ্রুত বাসায় ফিরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। গাজীপুরের সন্তান ফ্রান্সিস সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন ২০১৪ সালে। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই জেএফকে এয়ারপোর্টে চাকরি করেন। তারা পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তানের এমন মৃত্যুর জন্য দায়ী পুলিশ অফিসারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এই সংবাদ জেনে জ্যাকসন হাইটস সংলগ্ন লুথারেন চার্চের প্যাস্টর জেমস রয় ওজোনপার্কে উইনের মা-বাবা-ভাইয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছেন বুধবার সন্ধ্যায়। কিন্তু পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত থাকায় সরাসরি কারও সাক্ষাৎ পাননি।
জেমস রয় এ সংবাদদাতাকে জানান, মাঝেমধ্যেই মা-বাবার সাথে উইনকেও চার্চে দেখেছি। আমি তাকে শিশুকাল থেকেই দেখছি। মানসিকভাবে সামান্য অসুস্থ ছিলেন। ৬ মাস আগেও সে জ্যামাইকা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। তারপর তাকে কখনও অস্থির হয়ে কোনও বাজে কাজে লিপ্ত হতে দেখিনি বা শুনিনি। তার এই অকাল মৃত্যুকে মেনে নেওয়া যায় না। আমি নিজেও তাকে মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগদানের অনুরোধ জানিয়েছি। কারণ, তার শরীর-কাঠামো অত্যন্ত উপযোগী সেনাবাহিনীতে তড়তড় করে উপরে উঠার ক্ষেত্রে।
উইনের ছোটভাই উৎস জানায়, মাসে একবার করে সে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়তো। অন্যসময় সে খুবই ভদ্র ও নম্র থাকতো। তার লক্ষ্য ছিল মার্কিন সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার। নিউইয়র্ক সিটির জন এডামস হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা উইন সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়া নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিলম্ব সইছিল না। সে কারণে সে ওষুধও নিয়মিত গ্রহণ করছিল না।
সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী, এনওয়াইপিডির ফোর্স ডিভশন ইউনিটের পক্ষ থেকে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু হয়েছে। ওই দুই পুলিশ অফিসারের বডি ক্যামেরার ফুটেজ রিলিজ করা হলে প্রকৃত তথ্য সহজেই উদঘাটিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ইতোমধ্যেই অভিযুক্ত দুই অফিসারের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের চিফ অব পেট্রল জনছেল আরও জানান, আমাদের ওই দুই অফিসার দ্রুত ওই বাসায় গিয়েছিল জরুরি সহায়তার জন্য। এমন অবস্থায় ওই তরুণের মৃত্যু হওয়া খুবই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। এটা উইনের পরিবার এবং আমাদের পুলিশ বাহিনীর জন্যও খুবই কষ্টের। কারণ, আমরাও তো মানুষ। ওরা এসেছিল উইনের ডাকে সহায়তা করতে। তারা কখনওই কোনও ধরনের চাপ প্রয়োগে আগ্রহী ছিলেন না। উইন যদি সাড়া দিতেন তাহলে এমন পরিস্থিতির অবতারণা হতো না।