মিয়ানমার একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। দেশটির ভুকৌশলগত অবস্থান ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের কারনে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিধর দেশগুলোর চোখ রয়েছে মিয়ানমারের উপর। এসব দেশের নিজস্ব স্বার্থ আছে এবং এখানে তারা তাদের বিনিয়োগ, বাণিজ্য সম্ভাবনা এবং অন্যান্য প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেয়। মিয়ানমারের ক্ষমতায় যে সরকারই থাকুক না কেন তারা তাদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নেয়। দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে গৃহযুদ্ধ চলে আসছে। সেনাবাহিনীর সাথে ক্রমাগত সংঘাতে সেসব এলাকার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তা সত্ত্বেও মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগ, অস্ত্র বিক্রি, মাদক চোরাচালান এবং অন্যান্য লাভজনক বাণিজ্য চলছে। সাধারন জনগণের চাহিদা এখানে উপেক্ষিত। মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কিত সকল পক্ষ তাদের স্বার্থ দেখার পাশাপাশি জনগণের উন্নয়নের কথা আমলে নিলে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বাণিজ্য,বিনিয়োগ ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে এবং এতে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী।
মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে মিয়ানমারের নানা ধরনের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা চায় না কারণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারনে বাণিজ্যের ক্ষতির পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতির উপর চাপ ফেলে। আঞ্চলিক শক্তিধর চীন ও ভারতের মিয়ানমারে ব্যপক বিনিয়োগ রয়েছে। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারনে মিয়ানমারের ৫০০ সেনাসদস্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর ৩১,৩০০ চিন জাতিগোষ্ঠীর শরণার্থী মিজোরামে এবং ২০২৩ সালের মে মাস থেকে প্রায় ১২,০০০ কুকি মিয়ানমার থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত মণিপুরে আশ্রয় নেয়। ভারত মিয়ানমারের এই অঞ্চলে সীমানাপ্রাচীর তৈরি করার পরিকল্পনা করছে এবং ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম (এফ এম আর) বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতের প্রতিবেশী চিন রাজ্যের একটি বিশাল অংশ এখন চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (সি এন এফ) নিয়ন্ত্রণে। এটি ভারতের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের। ভারত মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার সমর্থন করলেও জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে সমর্থন দেয় না। ভারতের জন্য মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
মিয়ানমারে চীনের প্রধান বিবেচনার বিষয় হলো ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং চীনের বিনিয়োগ স্বার্থ। মিয়ানমারে চীনের মূল লক্ষ্য হলো চীন মিয়ানমার সীমান্তবর্তী শান সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত খনিসমৃদ্ধ এলাকায় চীনা বিনিয়োগ এবং অবকাঠামোগত স্বার্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এজন্য চীন বিদ্রোহী শান জাতিগোষ্ঠী এবং জান্তা সরকারকে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করেছে। বিদ্রোহী গুষ্টিগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় জান্তা সরকারের বাহিনী বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ বন্ধে অস্ত্রবিরতিতে সমর্থন দিয়েছে। চলমান সংঘর্ষের কারনে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলারের সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে তাই চীন দ্রুত এই অবস্থার অবসান চায়।
রাখাইন অঞ্চল ভবিষ্যতে আরাকান আর্মি (এ এ) ও ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউ এল এ ) প্রভাব বলয়ে থাকবে, তাই চীনকে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নর্দান শান স্টেট পর্যন্ত চীনের গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন রয়েছে। এ সরবরাহ কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হলে চীনের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। চীন রাখাইনে যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করেছে, তা তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোডস উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ ছাড়াও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তপথে চীনের বাণিজ্যের পরিমাণ পাঁচ বিলিয়ন ডলার। চীন এই বাণিজ্য চলমান রাখতে তৎপর।
চলমান রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি মিয়ানমার সীমান্তে সংঘর্ষের কারনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি হুমকির মুখে রয়েছে। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ রাখাইন ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সহায়তা চেয়ে আসছে। মিয়ানমার সংক্রান্ত যে কোন সংলাপ ও কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। বাংলাদেশকে এ এ, রাখাইনের রাজনৈতিক দল এবং জনগণের সাথে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। রাখাইনের অশান্ত পরিস্থিতি ও নতুন করে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত জনগনের আগমন ঠেকাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ও জাতিসংঘের সাথে রাখাইনে মানবিক করিডোর তৈরি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
সংকটের কারনে মিয়ানমার থেকে সীমান্ত অতিক্রমকারী বিপুল সংখ্যক অনিবন্ধিত অভিবাসী থাইল্যান্ডের জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগের পাশাপাশি তাদের জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী দক্ষিণ-পূর্ব মিয়ানমারে প্রায় ৭৬৪,৫৫৫ জন আইডিপি অবস্থান করছে। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সীমান্ত অঞ্চলে সাইবার অপরাধ থাইল্যান্ডের জন্য হুমকি স্বরূপ। মাদক পাচারও থাইল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ, মেথামফেটামিন পাচার মিয়ানমারের অর্থ সমাগমের একটি অন্যতম খাত, থাইল্যান্ড এই অঞ্চলে মাদক বিতরণের অন্যতম একটি প্রবেশদ্বার।
থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়া মিয়ানমারকে সম্পূর্ণরূপে আসিয়ান পরিবারে দেখতে চায়। থাইল্যান্ড এবং লাওস সক্রিয়ভাবে মিয়ানমার জান্তাকে এই ফোরামে পুনরায় সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছে। থাইল্যান্ড মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে। মানবিক করিডোরটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছে খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহের পাশাপাশি মিয়ানমারের ভেতরের বাস্তুচ্যুত প্রায় ২০০০০ মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছাতে সহায়তা করবে। মানবিক সংকট মোকাবেলা রাজনৈতিক সংলাপের পথকেও প্রশস্ত করবে বলে তারা মনে করে।
২০২১ সালের সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহনের পর এন এল ডি ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট অব মিয়ানমার’ (এন ইউ জি) গঠন করে। এন ইউ জি’র মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার গোষ্ঠীর আধিপত্য কমাতে সিভিল সোসাইটি এবং ই এ ও এবং অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। এন ইউ জি কে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাথে সহযোগিতা বাড়িয়ে তাদের উপর বিশ্বাস ও আস্থা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এন ইউ জি কে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি প্রবাসী বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ততা ও যোগাযোগ স্থাপন করারও উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিগত গোষ্ঠীগুলির বিভিন্ন আকাঙ্খাকে একত্রিত করে বিশ্বাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এন ইউ জি কে সামনের দিনগুলোতে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে । এন ইউ জি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন মার অং মনে করে যে, একটি নতুন সংবিধান প্রনয়নের মধ্যে দিয়ে ফেডারেল গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠাই মিয়ানমারের জন্য প্রয়োজন। তবে এখন পর্যন্ত এন ইউ জি অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে একত্রে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিসত্তাকে রক্ষা করার জন্য একটি ফেডারেল সংবিধান তৈরি করতে পারেনি।
মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে সেখানে বিশ্বাসযোগ্য একটি প্লাটফর্ম তৈরি না হওয়া পর্যন্ত জান্তা সরকারের পতনের সম্ভাবনা কম। বিদ্রোহীদের হাতে যাওয়া এলাকাগুলো ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ সেনাবাহিনীর হাতে আছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা দেশগুলো এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো জান্তা সরকার দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের দ্রুত পতনের সম্ভাবনা নাই বলে মনে করে। আপাতঃদৃষ্টিতে সেনাবাহিনী কিছুটা কোণঠাসা হলেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে দুর্বল ভাবার কোন অবকাশ নেই। তার বদলে একটা শান্তিপূর্ণ এবং সম্মানজনক উপায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এতে সব পক্ষই তাদের মুখরক্ষা করতে পারবে। তাই চলমান পরিস্থিতিতে চীন এবং ভারত উভয়ই তাদের বর্তমান নীতির পরিবর্তন আনবে না বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করে। মিয়ানমারের পরিস্থিতিতে আমেরিকাও বার্মা অ্যাক্টের মাধ্যমে এন ইউ জি , পিডিএফ, ও অন্যান্য ই এ ও’র মাধ্যমে জান্তা সরকারকে চাপে ফেলে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সহ প্রতিবেশী এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মহল আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমার পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। মিয়ানমারের জনগণ দেশকে বিচ্ছিন্ন মনোভাব মুক্ত, শান্তি ও ঐক্য ফিরিয়ে আনতে পারে এমন যেকোনো সংগঠন বা ব্যক্তিকে সমর্থন করবে। মিয়ানমারের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আঞ্চলিক দেশগুলো ও মিয়ানমারের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শক্তিধর দেশকে এজন্য মুখ্য ভুমিকা পালন করতে হবে। মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কিত সব পক্ষকে তাদের বিভেদ ভুলে একত্রে কিছু করার এটাই সময়, তাই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের শান্তির জন্য সকল পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল (অবঃ), মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।