আগুন দিয়ে পুড়িয়ে যারা মানুষ মারে, তারা কি রাজবন্দি হয়– এমন প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষ খুন আর অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনায় কোনো ছাড় নয়। বিএনপি-জামায়াত দিনের পর দিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। অগ্নিসন্ত্রাস করছে। পুড়িয়ে মানুষ মরছে। এ ধরনের অপরাধ যারা করে, তাদের ক্ষমা করা যায় না। তাদের শাস্তি পেতেই হবে। হুকুমদাতা, অর্থপ্রদানকারী আর সরাসরি জড়িত কেউই রেহাই পাবে না।

প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে এসব কথা বলেন। এর আগে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর অধিবেশনের সমাপনী-সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ পড়ে শোনান স্পিকার।

নির্বাচন-পূর্ববর্তী ঘটনার সময় বিএনপির নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির তরফ থেকে দেশে-বিদেশে বারবার লেখা হচ্ছে, তাদের এত লোক অ্যারেস্ট। তারা দেশ-বিদেশে নালিশ করছে। বিএনপির সব নাকি রাজবন্দি। যারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মারে, তারা কি রাজবন্দি হয়? তারা তো সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী এবং অপরাধী। রাজনৈতিক কারণে তো কেউ গ্রেপ্তার নেই। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা হুকুমদাতা না হয় সরাসরি অগ্নিসন্ত্রাসে জড়িত, অথবা অর্থপ্রদানকারী। এই হুকুমদাতা, অর্থপ্রদানকারী আর সরাসরি জড়িতদের কেউ রেহাই পাবে না। এটা হলো বাস্তবতা।

সংসদ নেতা দলীয় এমপিদের উদ্দেশে বলেন, যারা এ ধরনের অপরাধ করেছে, যেসব মামলা চলছে, সেই মামলাগুলো যেন যথাযথভাবে চলে। সাক্ষী-সাবুদ যেন হয়। শাস্তি যেন তারা পায়। তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এদের চরিত্র মানুষ খুন ও দুর্নীতি করা। লন্ডন থেকে হুকুম আসে। আর তারা এখানে আগুন দেয়। মানুষ খুন করে। আবার তার ছবিও পাঠাতে হয়। কী চমৎকার কথা! ভিডিও কনফারেন্সে হুকুম আসে। তারা তামিল করে। আগুন দিয়ে মানুষ ও পুলিশ মেরে সেই ছবি পাঠায়। তাহলে আর সাক্ষী-সাবুদ কী দরকার। তারা নিজেরাই আলামত রেখে দিচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তার করলে সেটা রাজবন্দি হয় কী করে? একজন হাজার মাইল দূরে বসে হুকুম দেয়। আর তামিল যারা করে, তাদের যে বিপদে ফেলে– এটা কি বিএনপির নেতাকর্মীরা বোঝে না? আরেকজন বলছে, ছবি গোপনে দাও। ছবি না দিলে নাকি তাদের ক্রেডিট থাকে না নেতার কাছে। এ কেমন নেতা! দূরে নিজে নিরাপদে থেকে হুকুম চালায়। আর এরা জানি না কী ধরনের কর্মী। তিনি সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।

গাজায় ইসরায়েলের হামলার মতো বাংলাদেশেও বিএনপি হাসপাতাল, পুলিশ ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি পুলিশকে আক্রমণ করছে। হাসপাতালে আক্রমণ করছে। গাজায়ও ফিলিস্তিনের ওপর এমন হামলা করা হচ্ছে। হাসপাতালে বোম্বিং হচ্ছে। নারী-শিশুসহ সবাইকে মারা হচ্ছে। সেখানে আজরাইল হয়ে আছে ইসরায়েল। আর বিএনপি বাংলাদেশের জন্য আজরাইল হয়ে এসেছে। তারা নির্বাচন করবে না। কারণ তারা জানে ভোট পাবে না। সমর্থন পাবে না। এ জন্যই জনগণের ওপর তাদের আস্থা নেই।

প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, সুষ্ঠুভাবে সংসদ চলবে। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। দেশে-বিদেশে নালিশ করে কোনো ফায়দা হবে না। বিদেশিরা কী বলল, সেটা দিয়েও চলবে না। কেননা, এবারের মতো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন দেশে আর হয়নি। তিনি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক দলসহ তাদের জোট অংশগ্রহণ করেনি। তবে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ দেশের মানুষ প্রার্থী হয়। ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী ছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ৪৩৬ জন। এই নির্বাচন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনে নারী ও তরুণ ভোটারদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।

তিনি আরও বলেন, আমরা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখা ও দেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। মানুষ সুফল পাচ্ছে। এ জন্য তারা আওয়ামী লীগের ওপর বারবার আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে। আওয়ামী লীগকে বারবার নির্বাচিত করে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। সরকারপ্রধান সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশন, জনগণসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের উন্নয়ন হয়। এটা তো বাস্তব সত্য। তা প্রমাণ করেছি। ১৫ বছরে এটা প্রমাণ হয়েছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা আছে বলেই দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এখন আমাদের লক্ষ্য, দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

সংসদে কাজে সহযোগিতা করার জন্য সরকারি দল, বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র এমপিদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। টেবিল চাপড়ে এমপিরা প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানান। স্বতন্ত্র এমপিদের টেবিল চাপড়ানোর শব্দ বেশি জোরে হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী হাসির ছলে বলেন, মনে হচ্ছে স্বতন্ত্রদের চোটপাট বেশি। তিনি বলেন, আমরা দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাব। মানুষের কল্যাণে পরিকল্পনা গ্রহণ করব। চলমান পরিকল্পনা দ্রুত শেষ করব। পাশাপাশি দেশে যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে এবং দ্রব্যমূল্য যাতে নিয়ন্ত্রণ হয়, তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করব। রমজানে দ্রব্যমূল্য যাতে সহনশীল থাকে, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যপণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কৃষক যাতে পণ্যে ন্যায্যমূল্য পান, সেই উদ্যোগও নেওয়া হবে। কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে।

মন্ত্রীদের দেওয়া নির্দেশনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে উপকারিতার ক্ষেত্রে দেশের জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিদেশি ঋণ ও সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা ও জবাবহিদি নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার উপকারভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সত্যিকার যারা প্রাপ্য, তাদের খুঁজে বের করা হবে।

৭৫-পরবর্তী নির্বাচনগুলোর ঘটনা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, কেন নির্বাচনে বাধা দেওয়া? ৭৫-এর পর প্রতিটি নির্বাচন তো আমরা দেখেছি। সেই হ্যাঁ-না ভোট। নির্বাচন কমিশনে তালা দিয়ে ভোটের রেজাল্টই নেই। তিন-চার দিন পর রেজাল্ট। শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যের জবাবে বলেন, তিনি কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ নির্বাচনের রেজাল্ট দেখাননি। দ্বিতীয় নির্বাচন কীভাবে করেছিল। তৃতীয় নির্বাচনে বিরোধীদলীয় নেতার ভাই (এরশাদ) মিলিটারি ডিকটেটর ক্ষমতায়। এক মিলিটারি ডিকটেটর ভোট চুরির রাস্তা দেখিয়ে গেল। ক্ষমতার দখলটা দেখিয়ে গেল। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরেকজন…। দু’জনেরই একই খেলা। সেনাপ্রধান হলেন। এক দিন ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে গেলেন। একই সঙ্গে দুই রূপ। রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে ভোট চুরি। খুশি হতাম, বিরোধীদলীয় নেতা যদি তাঁর ভাইয়ের ১৯৮৮-এর নির্বাচনের রেজাল্টটা দেখাতেন। সেই নির্বাচনটা ছিল শুভংকরের ফাঁকি। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এরশাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করল খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে। অবশ্য তিনি দেখিয়েছেন ২১ শতাংশ ভোট। ২১ শতাংশ কীভাবে হলো। সেদিন তো কোনো ভোটার ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেননি। হোন্ডা-গুন্ডা দিয়ে নির্বাচন ঠান্ডা। এরশাদের নির্বাচন টেকেনি। খালেদা জিয়ার নির্বাচনও টেকেনি। জনগণের রুদ্ধরোষে ভোট চুরির অপরাধে বিদায় নিতে হয়েছিল।

শেষ হলো দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর স্পিকার জানান, ৩০ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ২২ দিন। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরের জন্য ৮৬টি প্রশ্ন জমা পড়ে। এর মধ্যে ৪৫টি প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীদের জন্য প্রশ্ন জমা পড়ে ১ হাজার ৮২২টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০টি প্রশ্নের উত্তর দেন মন্ত্রীরা। ৭১ বিধিতে জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোটিশ জমা পড়েছে ২৫০টি। এর মধ্যে ১৫টি নোটিশ আলোচনার জন্য গৃহীত হয়েছে। ৯টি নোটিশ আলোচিত হয়েছে। বিল পাস হয়েছে দুটি।

অধিবেশনের প্রথম দিনে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ভাষণ দেন। এই ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব উত্থাপন করেন চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী। পরে এই ভাষণের ওপর সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা আলোচনা করেন। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনা হয় প্রায় ৪০ ঘণ্টা। আজ শেষ দিনের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও অংশ নেন বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের, উপনেতা মতিয়া চৌধুরী ও চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী।