মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির (এ এ) চলমান সংঘর্ষের সংঘর্ষের কারনে জীবন বাঁচাতে ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যসহ ৩৩০ জন বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। এই সীমান্তরক্ষীদের দ্বারা সংগঠিত নির্মম নির্যাতনের কারনে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রাখাইন রাজ্যে থেকে রোহিঙ্গারা প্রানভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, এখন তারাও নিজ দেশ থেকে প্রানভয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে বান্দরবান ও কক্সবাজারের সীমান্ত অঞ্চলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে এ এ’র সঙ্গে বি জি পি’র ব্যাপক সংঘর্ষ চলে। সংঘর্ষের তীব্রতায় নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমঘুম থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং পর্যন্ত সীমান্ত বরাবর মিয়ানমারের ডজনখানেক সীমান্ত চৌকি থেকে বিজিপি সদস্যরা অস্ত্রসহ পালিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে বিজিবি’র কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এসময় মিয়ানমারে সীমান্তের ওপার থেকে থেকে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনায় বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ৫ই ফেব্রুয়ারি ঘুমধুম ইউনিয়নের একটি গ্রামে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দু’জন বাংলাদেশী নিহত হয়। চলমান সীমান্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের সবকটি ক্যাম্প এ এ’র দখলে রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরের সমগ্র সীমান্ত এলাকা বিজিবির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং সীমান্তে টহল ও জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিজিবি সীমান্তের পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে ও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। মিয়ানমারে সরকারি বাহিনী ও এ এ’র মধ্যে চলমান সংঘাতে ধৈর্য ধরার জন্য বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবিকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের আর কোন নাগরিককেও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলেও বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। দুই দফায় বাংলাদেশের একটি জাহাজে করে তাদেরকে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করা মিয়ানমারের জাহাজে তুলে দেয়া হয়। এদের মধ্যে মিয়ানমারের বিজিপি, সেনা, ইমিগ্রেশন ও পুলিশের সদস্য রয়েছে। এদের মধ্যে আহত সদস্যদেরকে মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ চিকিৎসাসহায়তাওদিয়েছে।দুই দেশের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে এই কার্যক্রম গ্রহন করা হয়। দ্রুত তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সফলতার সাথে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেছে। এ এ’র আক্রমনের মুখে পালিয়ে আশা বি জি পি সদস্যরা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি দেখে গেছে, তারা ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের বিষয়ে মিয়ানমারকে অবহিত করবে এবং এদের কাছে থেকে মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষ, সীমান্তের যোগাযোগ ব্যবস্থা, সীমান্তরক্ষীদের আচরণ, তাদের অস্ত্রসস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে অনেক তথ্য পাবে। পালিয়ে আসা মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীদের সাথে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নিতিমালা মেনে আচরন করেছে ও করছে যা এই অঞ্চলের জন্য অনুস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
২০২১ সালের মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে এই প্রথম বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে জান্তা সরকার। সশস্ত্র বিদ্রোহী গুষ্টির জোট ব্রাদারহুড এলায়েন্সের সমস্ত সেক্টর ব্যাপী একসাথে আক্রমনে জান্তা বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অব্যাহত সংঘর্ষের কারণে সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের মংডু অঞ্চল থেকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে।
মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে এ এ’র সাথে এর আগে ও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে তবে, এই প্রথমবার মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রানভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিল। এর থেকে আরাকান আর্মির প্রস্তুতি ও সংঘর্ষের তীব্রতা সম্বন্ধে ধারনা পাওয়া যায়। তবে মিয়ানমার এত সহজে তাদের আধিপত্য ছেড়ে দিবে না, ক্যাম্প পুনরুদ্ধার করতে মিয়ানমারের জান্তাবাহিনী যেকোনো মুহূর্তে হামলা চালাতে পারে। ফলে এই অঞ্চলে পুনরায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষের কারনের জান্তা বাহিনী জনবল সংকটে রয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সকল পুরুষকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে অন্তত দুই বছর কাজ করা বাধ্যতা মুলক করে আইন পাস করছে মিয়ানমার সরকার এবং এই আইন না মানলে জেলে যাওয়ার বিধান রাখা হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী একটা দীর্ঘ মেয়াদি সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তবে এবারের এই ঘটনায় সমগ্র মিয়ানমার এবং রাখাইনও জান্তার একছত্র আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এবং বালেন্স অব পাওয়ার এ এ’র দিকে সরে এসেছে। ভবিষ্যতের জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে থাকবে। সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যের সংঘাতের কারনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে। রাখাইন অঞ্চলের এই সংঘাত দ্রুত সমাধান করা না গেলে শুধু বাংলাদেশ-মিয়ানমার নয় পুরো অঞ্চল জুড়ে অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
এই অঞ্চলের দিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি রয়েছে, রাখাইনকে ঘিরে দুই পরাশক্তির বিরোধ দেখা দিলে এখানে সংঘাত বাড়বে এবং জটিল এক আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংকট তৈরি হবে। দূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে রাখাইন অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ সুগম হয়। রাখাইনের রাজনীতিতে ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান (ইউএলএ) গুরুত্বপূর্ণঅবস্থানেরয়েছে।এই প্রথমবারের মত রাখাইনের সীমান্ত আরাকানের রাজনৈতিক শক্তির দখলে এসেছে। আরাকানের স্বাধীনতা হারানোর পর থেকে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। এটা কতটুকু স্থায়ী হবে সেটা না ভেবে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে অনানুষ্ঠানিক ভাবে ইউ এল এ ও এ এ’র সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি একটা কমিশন বা সংগঠন তৈরি করা দরকার যারা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ও অন্যান্য যোগাযোগ ও কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাবে। এই কমিশনকে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রনালয় ও সংস্থা সহযোগিতা করতে হবে। এই কমিশন রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাদের অগ্রগতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমস্যার কারনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হতাহতের ঘটনা ঘটছে যা অনভিপ্রেত। এ কারনে মিয়ানমারের সাথে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে যে কোন ধরনের যোগাযোগ ও আলোচনায় বাংলাদেশের উপস্থিতি ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমার সরকারের সাথে কূটনৈতিকভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে মিয়ানমারের দিকের বর্ডার পোস্টগুলো এ এ’র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই সময় তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও সীমান্ত এলাকা ও মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ ভাগের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এন ইউ জি ও এ এ’র সাথে অনানুষ্ঠানিক ও বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপন ও তা চলমান রাখতে হবে। রাখাইনের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে তা চালিয়ে যেতে হবে। এন এল ডি’র শাসনামলে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে দেশছাড়া করা হয়েছিল। এখন এন ইউ জি কিছুটা নমনীয় মনভাব দেখিয়েছে যা আশাব্যঞ্জক। বর্তমান পরিস্থিতিতে এন ইউ জির সাথেও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে কিনা এবং তাদেরকে তা বিবেচনায় রাখার প্রক্রিয়ায় রাখতে হবে। রাখাইনের সহনশীল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। রাখাইনের বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তাদের কার্যক্রম ও সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।
মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে কী হচ্ছে বা কী হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে। বার্মিজ ভাষায় দক্ষ জনবল একাজে নিয়োগ করতে হবে। মিয়ানমার তথা আরাকান সম্পর্কে আমাদের ধারনা সীমিত, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমাদেরকে মিয়ানমার সম্পর্কে বিশেষত রাখাইন রাজ্য সম্পর্কে বিশেষ ধারনা লাভ করতে হবে। মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনসাধারণ, সম্পদ বা সার্বভৌমত্ব কোনও ভাবে যাতে হুমকির মুখে না পড়ে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী পুনরায় দখল হয়ে যাওয়া ঘাঁটিগুলো উদ্ধারের উদ্যোগ নিলে পুনরায় সীমান্তে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়বে এবং বাংলাদেশের ভেতরে এক ধরণের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হবে। বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের চলমান সংঘাতের বিষয়টি বিশ্ব সম্প্রদায়ের গোচরে আনতে হবে এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে এই সমস্যা সমাধানে সম্পৃক্ত করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ সাফল্যের সাথে চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। সামনের দিনগুলোতে উদ্ভুত সংকট মোকাবেলায় তেমনিভাবে বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অবঃ) মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক