যুদ্ধ দুই ধরনের, বন্দুকযুদ্ধ এবং তথ্যযুদ্ধ। যে দেশগুলো এখন যুদ্ধ করছে, তাদের লড়াইটা এই দু’দিক থেকেই। কিন্তু আমাদের জন্য এটি প্রকৃত ঘটনা জানার কাজটি কঠিন করে দেয়। তবে অন্য যেকোনো যুদ্ধের মতো এই যুদ্ধের ক্ষেত্রেও এটি সত্য এবং মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে রাশিয়ার নির্লজ্জ মিথ্যা ও গুজবের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
গত দশকে ঘটে যাওয়া মাত্র দু’টি ঘটনার উল্লেখ করতে হলে- এমএইচ১৭ বিমান বিধ্বস্ত করা এবং সালিসবারি নভিচক বিষক্রিয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে এটি প্রমাণিত হয়েছে।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের শুরুটাও একটা মিথ্যার ওপর ভর করে হয়েছিল। সেই মিথ্যা দাবিটি হলো- নাৎসি শাসনব্যবস্থা রাশিয়ান ভাষাভাষীদেরকে ‘গণহত্যার’ ঝুঁকিতে ফেলছে।
এর অর্থ এই নয় যে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও ক্রেমলিনের প্রতিটি শব্দ মিথ্যা। অথবা, ওখানকার এমপিদের ও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিটি শব্দ অসত্য।
তবে এটা যেহেতু প্রায়ই ঘটে, তাদের কোনো কিছু পুনঃপ্রচারের আগে আরো ভালোভাবে যাচাই করা জরুরি।
এবার ‘আইএল-৭৬’ নামক পরিবহন বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার খবরটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থায়।
মস্কোর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃত করে তারা দাবি করে, বিমানটিতে কয়েক ডজন ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দী ছিলেন এবং ঘটনাটি ঘটে বন্দী বিনিময় করতে যাওয়ার পথে।
যদিও কিয়েভ এ বিষয়টি নিশ্চিত করেনি এবং রাশিয়ার পক্ষ থেকেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
রুশ এমপি আন্দ্রেই কার্তাপোলভ প্রায় সাথে সাথেই একই বিবৃতি দিতে শুরু করেন। এমনকি তিনি এ মন্তব্যও করেন যে এই বিমান হামলায় ইউক্রেন হয়তো প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে।
এর অর্থ দাঁড়ায়, এই অস্ত্র পশ্চিমাদের সরবরাহকৃত। এটি একটি বড় দাবি এবং এর সমর্থনে এখনো কোনো প্রমাণ নেই।
এ ধরনের আলোচনা ক্রমশ জোরালো হয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়লেও ইউক্রেন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
রাশিয়ার কোলাহলাই এই নিরবতায় গমগম করে বাজছে।
কিয়েভে আমরা গুজব শুনতে শুরু করি যে আজ একটি বন্দী বিনিময়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তারপর একটি উৎস থেকে এটি নিশ্চিতও করা হয়েছে। কিন্তু কিয়েভের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে তা বলতে রাজি হননি।
আমরা যাদের কাছে তথ্য চেয়েছি, তারা সবাই আমাদের বলেছে, ‘এখনো না’, অথবা ‘আমরা তথ্য যাচাই করছি’ বা ‘অপেক্ষা করছি’। টানা আট ঘণ্টা ধরে কিছুই ছিল না।
এতে রাশিয়ার জল্পনা-কল্পনা বন্ধ হয়নি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউক্রেন উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার নিজের সৈন্যদের হত্যা করেছে, এমন বুনো দাবিও। এ যুক্তিটি এতটাই বিকৃত যে এটি পুনরাবৃত্তি করার মতো নয়।
কিন্তু এ ধরনের কথাবার্তা উড়িয়ে দেয়ার অর্থ এই নয় যে ইউক্রেনের দ্বারা এই ‘ভয়ানক ভুল’ করার সম্ভাবনাকে খারিজ করে দেয়া। সর্বোপরি, আমরা জানি যে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং এটি করার ক্ষমতা ইউক্রেনের রয়েছে।
এর আগে, ইউক্রেইনস্কা প্রাভদা নিউজ তাদের ওয়েবসাইটে সশস্ত্র বাহিনীর একটা সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলেছে যে এটি ‘তাদের কাজ’ এবং বিমানটি রাশিয়ার এস৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করছিলো। অন্য অর্থে, এটি একটা সাফল্য হিসেবেই দেখা হচ্ছিল।
পরে তা সংশোধন করা হয় এবং বলা হয় যে সেই উৎসটি যাচাই করা হয়নি।
তারপর, আজ সন্ধ্যায় আমরা অবশেষে দু’টি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পেলাম।
বিবৃতি দু’টি এসেছে জেনারেল স্টাফ এবং ইউক্রেনীয় সামরিক গোয়েন্দার কাছ থেকে। তারা একসাথে স্বীকার করে যে ইউক্রেন বিমানটি বিধ্বস্ত করতে পারে। যদিও কেউই তা সরাসরি বলেননি।
ইউক্রেন জোরালোভাবে বলেছে যে বিমানটিতে কারা ছিল, সে ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। কিন্তু তারা এটা নিশ্চিত করেছে যে বুধবার একটি বন্দী বিনিময়ের পরিকল্পনা থাকলেও তা হয়নি।
তারা আরো বলেছে যে বন্দী বিনিময়ের জন্য কোন পথ এবং পরিবহন ব্যবহার করা হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সে বিষয়ে রাশিয়া সাধারণত আগে থেকেই তথ্য দেয়।
কিন্তু এবার এর কোনোটাই ছিল না বলে জানিয়েছে ইউক্রেন।
এদিকে, জেনারেল স্টাফের বিবৃতিতে বিমানে গুলি চালানোর এ ধরনের ঘটনাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা হলেও তারা ঠিক কী করেছিল সেটি স্পষ্ট করা হয়নি।
রাশিয়া ইদানিং বেলগোরোদ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বাড়িয়েছে। বিশেষ করে, খারকিভে যেখানে তারা কয়েক ডজন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা ও আহত করেছে।
বুধবার সকালে বিধ্বস্ত হওয়া এ ধরনের পরিবহন বিমানগুলো সাধারণত অস্ত্র সরবরাহ করে, যা পরে সীমান্ত জুড়ে নিক্ষেপ করা হয়।
সুতরাং, এই সন্ধ্যায় কিছু উত্তর, কিছু ইঙ্গিত এবং অজস্র দাবি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারছি না যে ওই বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া বিমানে কে বা কারা ছিলেন। আমরা জানি না যে কিয়েভের আরো কত কর্মকর্তা ইতোমধ্যে বিষয়টি জানেন, বা বলছেন না।
পরিবহন বিমানটিতে যদি ইউক্রেনীয় সৈন্য থাকে, তাহলে রাশিয়াকে শেষ পর্যন্ত প্রমাণ সরবরাহ করতে হবে এবং ইউক্রেনকেও এর পূর্ণাঙ্গ জবাব দিতে হবে।
কারণ আজ রাতে সমগ্র ইউক্রেনের হাজার হাজার পরিবার উদ্বিগ্ন অবস্থায় থাকবে এবং তারা অপেক্ষা করবে। কারণ তাদের অনেকের আত্মীয়রা রাশিয়ায় যুদ্ধবন্দী হিসেবে আছে।
সূত্র : বিবিসি