পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার মজুরি বোর্ডের ঘোষণা প্রত্যাখান করে আন্দোলনে নেমেছে গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। বুধবার মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় পোশাক শ্রমিকরা বিক্ষোভ, ভাংচুর ও সড়ক অবরোধ করেছে। এসময় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। দিনভর সংঘর্ষে বিভিন্ন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিনত হয়। এতে এক নারী নিহত ও অন্ততঃ ২০জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে সংঘর্ষকালে পুলিশের এপিসি কারে বিষ্ফোরণে দুইজন সহ পুলিশের ৮ সদস্য আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ সর্টগানের গুলি, টিয়ারসেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে।
জানাগেছে, মঙ্গলবার (৭ নবেম্বর) মজুরি বোর্ড পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে ঘোষণা দেয়। ওই সিদ্ধান্তে শ্রমিকরা সন্তুষ্ট না হওয়ায় বুধবার সকাল থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করেন। বুধবার সকাল থেকে গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ি এলাকার স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টস লিমিটেড, রিপন নিটওয়্যার লিমিটেড, ইসলাম গার্মেন্টস ও বেস্টঅল সোয়েটারসহ আরও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে কারখানার সামনেই বিক্ষোভ শুরু করলে কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। সকাল ৮টার দিকে কাশিমপুর, জরুন, হাতিমারা সহ আশে পাশের এলাকার বিভিন্ন কারখানার সহ¯্রাধিক শ্রমিক লাঠিসোটা সহ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জরুন মোড় এলাকায় জড়ো হয়। এসময় তারা কাঠ ও টায়ারে আগুন ধরিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এসময় পুলিশ মহাসড়কের উপর থেকে অবরোধকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এসময় পুলিশ সর্টগানের গুলি, টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এঘটনায় নারীসহ কয়েকজন আহত হয়েছে। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে ও ক্লিনিকে পাঠানো হয়। আহতদের মধ্যে আঞ্জুয়ারা খাতুন (২৪) ও জালাল উদ্দিনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে উত্তেজিত শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে রওশন মার্কেটের হয়ে হাতিমারার দিকে এগিয়ে যায়।
আহত আঞ্জুয়ারা খাতুনকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢামেক হাসপাতালে মৃত ঘোষণা করেন সেখানকার চিকিৎসক। তিনি গাজীপুরের কোনাবাড়ী জরুন এলাকার ইসলাম গার্মেন্টসের ইউনিট নং-২ এর সেলাই মেশিন অপারেটর পদে চাকরি করতেন। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থানার চরগিরিশ এলাকায় বলে জানিয়েছেন নিহতের স্বামী জামাল বাদশা ও ভাই মোস্তফা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দু’জন ঢামেকে এসেছিলেন। এদের মধ্যে আঞ্জুয়ারা নামে এক নারীকে মৃত ঘোষণা করেছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। ময়না তদন্তের জন্য তার লাশ ঢামেক হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
এব্যাপারে কোনাবাড়ী থানার ওসি বলেন, নারী শ্রমিক নিহতের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নই। তবে গুরুতর আহত অবস্থায় ওই নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তিনি পদদলিত হয়ে নাকি অন্য কোনোভাবে আহত হয়েছেন তা জানা যায়নি।
এদিকে পুলিশের গুলিতে শ্রমিক হতাহত হওয়ার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন আন্দোলনরত শ্রমিকরা। মুহুর্তেই আশেপাশের কারখানাগুলোতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এতে আন্দোলনরতরা উত্তেজিত হয়ে উঠে। দুপুরের খাবারের বিরতির পর শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে ফের আন্দোলনে নেমে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা গাড়ি সহ বিভিন্ন কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠাণ ভাংচুর করে। একপর্যায়ে তারা কোনাবাড়ি এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের উপর অবস্থান নিয়ে অবরোধের চেষ্টা করে। এসময় পুলিশ বাঁধা দিয়ে মহাসড়কের উপর থেকে অবরোধকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। বিকেলের দিকে পুলিশ টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় শ্রমিকরা বিভিন্ন অলিগলিতে আশ্রয় নিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়তে থাকে। এতে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়।
এদিকে একদিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানাধীন নাওজোর এলাকায় আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টাধাওয়া হয়েছে। এতে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এসময় পুলিশের এপিসি কারে বিষ্ফোরণে পুলিশের ৫ সদস্য আহত হয়েছেন। আহতদেও মধ্যে একজনের হাতের কব্জি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। শ্রমিকরা পিছু হটে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। একপর্যায়ে তারা ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের সামনের ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করছে তারা।
গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম জানান, আহতবস্থায় পাঁচজন পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। এদের মধ্যে গুরুতর আহত পুলিশ সদস্য প্রবীর (৩০), ফুয়াদ (২৮) ও খোরশেদ (৩০) কে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। অপর আহত আশিকুল (২৭) ও বিপুলকে (২৪) এ হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে ফুয়াদের অবস্থায় বেশি গুরুতর, তার ডান হাতে আঙ্গুলে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, এপিসি কারের ভেতর যেসকল পুলিশ সদস্যরা ছিলেন তাদের অসাবধানতায় এপিসি কারের ভেতর বিস্ফোরক দ্রব্যের বিস্ফোরণে পুলিশ সদস্যরা আহত হয়। সকালে সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন ও বিকেলে নাওজোড় এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় অপর পাঁচজন হয়েছেন। বিকেলে যে পাঁচজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে এদের শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও এপিসি কারে বিস্ফোরণেও আহত হওয়া ঘটনা আছে।
তবে গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো: মাহবুব আলম বলেন, বুধবার শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে মোট আট জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। এরমধ্যে বিকেলে নাওজোড় এলাকায় সংঘর্ষ কালে এপিসি কারের ভিতরে বিষ্ফোরণে দুইজন আহত হয়েছেন। অন্য ৬জন শ্রমিকদেও ইটপাটকেলে আহত হয়েছেন।
অপরদিকে প্রায় একই সময়ে বিকেলে মহানগরীর নলজানী এলাকায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তরের সামনে স্থানীয় কজিমা গার্মেন্টস সহ আশেপাশের কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-জয়দেবপুর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এসময় তারা গাড়ি ও কারখানাসহ দোকানপাট ভাংচুর শুরু করলে পুলিশ বাঁধা দেয়। এসময় শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
বিজিবির লেফটেন্যান্ট কর্নেল রফিকুল ইসলাম জানান, বেতন বাড়ানোর দাবীতে গাজীপুরে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন ও বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রিজার্ভসহ ২২ প্লাটুন বিজিবি গাজীপুরে মোতায়েন করা হয়েছে। কয়েকটি স্থানে সকালে সমস্যা হয়েছে।
জিএমপি’র কমিশনার আরো জানান, এখন শ্রমিকরা মহাসড়ক ছেড়ে চলে যাচ্ছে, পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হচ্ছে।
প্রসঙ্গতঃ ন্যূনতম মজুরী ২৩ হাজার টাকা করার দাবীতে গত ২৩ অক্টোবর থেকে আন্দোলন শুরু করে আসছে গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্প কারখানার শ্রমিকেরা। সংঘর্ষকালে এ পর্যন্ত ৩জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন।