বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের চলমান কর্মসূচিতে দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিকে সামনে নিয়ে আসছে।

রোববার সরকারকে দেয়া দলddটির ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে ‘বাঁক পরিবর্তন’ করার মতো কর্মসূচি আসতে পারে বলে বলছে বিএনপি নেতারা।

সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ধোলাইখাল এলাকায় এক জনসভায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে বলেন, ‘আজকে তিনি (খালেদা জিয়া) জীবন-মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন, এতই বেশি তার শরীর অসুস্থ যে ডাক্তাররা বলছেন অবিলম্বে তার বাইরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। সেই কারণে আমরা গতকাল বলেছি, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাকে বাইরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন, অন্যথায় এর সমস্ত দায়-দায়িত্ব এই সরকারকেই নিতে হবে।’

এর আগে রোববার মির্জাই ফখরুল নয়াপল্টনে আয়োজিত এক সমাবেশে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য দুই দিনের আল্টিমেটাম ঘোষণা করেন।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, ‘এখন আমরা যে কর্মসূচির মধ্যে আছি, এর বাইরে একটা কিছু হবে নতুন ধরনের, বাঁক পরিবর্তনের একটা ঘটনা হয়তো হবে, ধারণা করছি আরকি।’

যদিও সেটি ঠিক কী ধরণের কর্মসূচি তা বিস্তারিত বলেননি তিনি।

তবে আল্টিমেটাম নিয়ে বিএনপির অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ বা কর্মসূচির বিষয়ে জানাতে চাননি।

২০০৮ সালে বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করা হয়। ১০ বছর পর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মামলার রায়ে তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়। একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের আট তারিখে তিনি কারাবন্দী হন। দুই বছর কারাবাসের পর ২০২০ সালের মার্চে তাকে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়া হয়।

এরপর থেকে প্রতি ছয় মাস পর পর তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে বিএনপির নেতারা তাকে মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় রোববার এই আল্টিমেটাম দেয়া হলো।

এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘আল্টিমেটাম যিনি দিয়েছেন, তিনি বিএনপির সবচেয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তি। আর এই বক্তব্য দেয়ার আগের রাতে তিনি খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।’

‘সুতরাং সেখানে একটা নিজস্ব চিন্তা বা পরিকল্পনা নিয়েই তিনি বলেছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।’

পরিবারের পক্ষ থেকে অনুমতি চেয়ে আবেদন

বিএনপির সূত্র বলছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ স্থায়ীভাবে স্থগিতের দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর একটি আবেদনপত্র পাঠান খালেদা জিয়ার ভাই শামিম ইস্কান্দার।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে কোন আবেদন পাননি বলে সাংবাদিকদের জানানোর পর আজ থেকে ওই আবেদনপত্রটির কপি বিএনপির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখনো আমাদের কাছে আবেদনটি আসেনি। আমরা যতখানি মঞ্জুর করতে পারি, আমরা ততখানিই করে দিচ্ছি। এরপরে করতে হলে আদালতে যেতে হবে। আমরা আদালতের বাইরে যতখানি করতে পারি, সেটুকু করে দিচ্ছি।’

ওই আবেদনপত্রে তখন বলা হয়, ‘২৪ সেপ্টেম্বর নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার সপ্তম বারের মতো মুক্তির মেয়াদ শেষ হবে।’ এর আগে তার স্থায়ী মুক্তির আবেদনটি করা হয়।

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) লিভার সিরোসিস এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যার আধুনিক চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব নয়। তিনি পূর্বের মতোই উঠে দাঁড়াতে পারেন না, এমনকি কারো সাহায্য ছাড়া ওয়াশ-রুম কিংবা শোয়ার ঘরের বাইরেও যেতে পারেন না।’

খালেদা জিয়ার জীবন রক্ষার জন্য এবং তার শারীরিক সক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য জরুরি ভিত্তিতে উন্নতমানের ফিজিওথেরাপিসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে দেশের বাইরে চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

এমন অবস্থায় সব শর্ত শিথিল করে তাকে স্থায়ীভাবে মুক্তি এবং বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য দাবি জানানো হয় ওই আবেদনপত্রে।

এ বিষয়ে বিএনপি নেতা আলাল বলেন, তার পরিবারের পক্ষ থেকে তার আইনজীবীর মাধ্যমে যেহেতু আবেদনটা করা হয়েছে তাই, তার মুক্তি দেয়া হলে পরিবারের পক্ষ থেকেই তাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। খালেদা জিয়ার মেডিক্যল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো যাবে কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরণের মন্তব্য এসেছে।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মনে করি আইনগত একটা জটিলতা রয়েছে। হয়তো আদালতের একটা পারমিশনের প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা আইনের বাইরে, আমাদের মন্ত্রণালয় কিছু করতে পারবে না।’

খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আদালতে যেতে হবে?

সোমবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত রেখে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এখন আইনের যে পরিস্থিতিতে, সেখানে যদি কোনো পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে খালেদা জিয়ার আগের যে শর্তযুক্ত মুক্তি সেটি বাতিল করতে হবে এবং বাতিল করে আগের স-অবস্থানে যেতে হবে। স-অবস্থানে যাওয়ার পরে অন্য বিবেচনা করা যাবে।

‘আইনের যে অবস্থান এখন, সে অবস্থানে যেটা করা হয়েছে সেটা একটা ডান অ্যাক্ট… সেই কারণে আমার মনে হয় আইনের অবস্থান থেকে সরকারের আর কিছু করার নেই’।

তবে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সথে দ্বিমত পোষণ করছেন সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে আদালতের আলাদা অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তার মুক্তি দেয়া হয়েছে নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী। কাজেই বাকি সব পদক্ষেপও এই আদেশের আওতাতেই হওয়া সম্ভব।

তিনি আরো বলেন, ‘ফৌজদারি আইনের ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার চাইলে শর্ত সাপেক্ষে বা শর্ত ছাড়া যেকোনো বন্দীকে মুক্তি দিতে পারে।’

খালেদা জিয়াকে প্রথম মুক্তি দেয়া হয়েছে দুটি শর্ত দিয়ে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে তিনি বাড়িতে থাকবেন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাকে দেশেই চিকিৎসা নিতে হবে।

মালিকের মতে, আইনমন্ত্রী যা বলছেন যে শর্ত পরিবর্তন করা যাবে না, সেটা আসলে এরইমধ্যে পাঁচবার বদলানো হয়েছে।

‘প্রথমে তো ছয় মাসের মুক্তি দিয়েছে, তারপর সেটা যখন আবার ছয় মাসের জন্য বাড়াচ্ছে সেটার জন্য তো নতুন করে নির্বাহী আদেশ হচ্ছে, তার মানে সিম্পলি সরকার চাইলে ঢাকায় চিকিৎসা করার জায়গায় ঢাকা শব্দটা বাদ দিলেই হলো।’

এটা আদালতের ব্যাপার নয় উল্লেখ করে আইন বিশেষজ্ঞ মালিক বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালত এরই মধ্যে তার রায় দিয়েছেন।

আদালতের কাছে কয়েক বার তার জামিনও চাওয়া হয়েছে এবং সেটি নাকচ করা হয়েছে। তার মানে আদালতের ‘চ্যাপ্টার’ সেখানেই শেষ হয়ে গেছে।

‘আদালতে হয়তো যাওয়া যায়, কিন্তু এটা তো আদালতের ব্যাপার না, কারণ আদালত তো তাকে মুক্তি দেয় নাই। তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে নির্বাহী আদেশে।’

সূত্র : বিবিসি