এর আগে আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে উল্টো বাদী রোকসানা বেগম (৪৯) ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ইতোমধ্যে হাইকোর্টের ওই জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে, ১৭ আসামী টানা আট কার্যদিবস আদালতে অনুপস্থিত থাকলে গত ৯ আগষ্ট সবার বিরুদ্বে গ্রেফ্তারি পরোয়ানা জারি করেন চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত, (চট্টগ্রাম)।
বাদি জানান, চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোকারমসহ ১৭ আসামিকে এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখলেও পুলিশের কাছে তাঁরা অধরা কিংবা পলাতক। নিহতদের স্বজনেরা মনে করছেন, পুলিশের এমন নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, ২০২১ সালের ৩রা আগস্ট ইয়াসমিন আক্তার এ্যানীকে বোয়ালখালীর খরনদ্বীপ জৈষ্ঠপুরা নিজ বাড়ীতে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ফেলে তার স্বামী (প্রধান আসামি) বাবলু দে প্রকাশ তনু (৩০)।
এ নিয়ে গত একই বছরের ১৬ আগস্ট নিহত তরুণীর মা রোকসানা বেগম ‘চট্টগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে’ একটি সিআর মামলা (নং-১২৯/২০২১) দায়র করেন। মামলায় স্বামী বাবলু দে ও এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারসহ ১৮ জনকে আসামী করা হয়। বোয়ালখালী থানার মামলা নং-২১ (৮) ২১। জিআর ২১৩/২১।
জামিনে থাকা স্বামী বাবলু দে ছাড়া বাকি আসামিরা হলেন-চট্টগ্রাম বোয়ালখালী উপজেলার ৮নং শ্রীপুর খরণদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মোকারম (৫৬), জৈষ্ঠপুরা গ্রামের রতন চৌধুরী (৬৫), সাধন মহাজন (৬০), নিমাই দে (৪৫), শংকর দত্ত (৩৩), অরবিন্দ মহাজন (৫০), অরুন দাশ (৫০), দিলীপ দেব (৪৫), ইউপি সদস্য প্রদীপ সুত্রধর প্রকাশ মনছুনা (৪০), রাম প্রসাদ (৩০), রনি দে (৩০), অরুপ মহাজন (৪২), সমর দাশ (৫৫), রবীন্দ্র ধর (৬০), নিপুন সেন (৬০), ইউসুফ প্রকাশ ড্রেজার ইউসুফ (৩৫) ও পবন দাশ (৫৫)। এরা সবাই বর্তমানে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। প্রধান আসামি বাবলু দে বর্তমানে (২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে) জামিনে রয়েছেন।
এই হত্যা মামলাটি দীর্ঘ দুই বছর পর বিজ্ঞ আদালত স্বপ্রণোদিত হলে পলাতক ১৮ আসামীর বিরুদ্বে এফআইআর গ্রহণ করেন। মামলার ১৮ আসামীর মধ্যে ১নং আসামী বাবলু দে গ্রেফ্তার হয়ে চট্টগ্রাম ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ১৪৬ ধারায় জবানবন্দি দেন। এর একমাস পর বাকী ১৭ আসামী উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের অস্থায়ী জামিন পান।
এরপর বোয়ালখালী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল রাজ্জাক ও মামলার আইও এসআই সুমন কান্তি দে ১নং আসামীকে রেখে বাকী ১৭ জন আসামীর নাম বাদ দিয়ে ২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন। এদের একজন নিহতের স্বামী বাবলু দে ও অপরজন সুমন। তবে বাদি জানান, চার্জশিটে আসা সুমন এ ঘটনায় জড়িত নন। এক সুমনকে মামলা থেকে বাঁচাতে অন্য সুমনের নাম প্রতিবেদনে টেনে আনা হয়েছে।
বাদিপক্ষের আইনজীবি দাখিলকৃত এক তরফা যোগসাজেসী প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি ও ৬ সপ্তাহের জামিন বাতিল করে সকল আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি ফরোয়ানা ইস্যুর আবেদন করেন। কেননা, গ্রেফতার আসামি বাবলু দে ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতে এজাহারনামীয় আসামীদের বিরুদ্ধে ভিকটিম ইয়াসমিনকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ফেলার তথ্য আসলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা তাদের নাম বাদ দেন চার্জশিটে।
পরে একজন মুসলিম গৃহবধুকে হিন্দু রীতিতে পুড়িয়ে ফেলায় আদালত মামলাটি অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) কে তদন্তের দায়িত্ব দেন। পাশাপাশি বোয়ালখালী থানা কতৃক দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদন গৃহিত হলো না বলে আদেশ দেন। এরমধ্যে ১৭ আসামী টানা আট কার্যদিবস আদালতে অনুপস্থিত থাকায় তাদের বিরুদ্বে গ্রেফ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।
বর্তমানে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি-চট্টগ্রাম) এর পুলিশ পরিদর্শক নুর উদ্দিন জাহেদ চৌধুরী বলেন, ‘এ মামলার বাদির সাথে কথা বলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। মামলার তদন্তের স্বার্থে মিডিয়ায় এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। প্রতিবেদন দিলে জানতে পারবেন। তবে মামলাটি এখনো তদন্তাধীন।’
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘এ মামলাটি খুব আলোচিত মামলা। কেননা, এ ভিকটিম মুসলিম হলেও হিন্দু রীতিতে পুড়ানো হলো গৃহবধু ইয়াছমিন আকতার এ্যানীর লাশ। বাদী আর্থিকভাবে দুর্বল হওয়ায় মানবাধিকার সংগঠন বিএইচআরএফের সহায়তায় মামলাটি দায়ের করা হয়। এ নির্মম ঘটনায় জড়িত আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে, যা খুবই দুঃজনক। এদের সকলের বিরুদ্ধে আদালত ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে। পুলিশ বা অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যেন এসব হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করেন। সে প্রত্যাশা করছি।’
মামলার বাদী রোকসানা বেগম (৪৯) বলেন, ‘গত আগষ্ট মাসে ১৭ আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে আদালত। এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে আসামিরা বোয়ালখালীতে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করছে না।’
এ বিষয়ে জানতে বোয়ালখালী থানার ওসি আসহাব উদ্দিন এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও ফোন রিসিভ হয়নি। তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পটিয়া সার্কেল) ড. আশিক মাহমুদ বলেন, ‘থানায় ওয়ারেন্ট গেলে অবশ্যই তামিল করবে। তামিল না করার কোন সুযোগ নাই। আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে এটা সত্য নয়। হয়তো পলাতক রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ইয়াছমিন আক্তার এনি ও বাবলু দে দুজন দু ধর্মের। বাবলু ধর্ম পরিচয় গোপন রেখে মিথ্যে পরিচয়ে মুসলিম তরুণী এনির সঙ্গে গড়েন প্রেমের সম্পর্ক। এক পর্যায়ে বিয়ে করে সংসারও পাতেন। সেই সংসারে আলো ছড়ায় দেড় বছরের একটি কন্যা সন্তানও।
তবে সবকিছু ধুলিসাৎ হয়েছে মিনিটেই। ওই তরুণীকে নির্যাতন করে হত্যার পর হিন্দু রীতিতে পুড়িয়ে ফেলে বাবলু। মুসলিম নারীকে তার স্বামী কেন হিন্দু রীতিতে পোড়ালো-আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা চট্টগ্রাম জুড়ে সে সময় ব্যাপক আলোচনায় ছিলো।