গাজীপুরে সংসারের অভাব ঘোচাতে লেখাপড়া ছেড়ে একটি পেপার মিলে কাজ করতে গিয়ে মেশিনে কাটা পড়ে এক শিশু শ্রমিকের ডান হাতের কব্জি ও বাম হাতের চারটি আঙ্গুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে ওই শিশুটির বাবা-মায়ের অভিযোগ মেশিনে ভারী কাজ করতে অস্বীকার করায় তাকে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত মেশিনে ফেলে দেয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ এ ঘটনার সত্যতা পেলেও শিশুটির দায়িত্ব বা খোঁজ খবর নিচ্ছে না কারখানা কর্তৃপক্ষ। গত ৮ জুলাই মহানগরীর পূবাইল থানাধীন কুদাব এলাকার মাস্টার সিমেক্স লিমিটেড নামের কারখানায় এ ঘটনা ঘটে।
মেশিনে কাটা পড়ে হাত বিচ্ছিন্ন হওয়া হতভাগা শিশুর নাম ইসমাইল হাসান সোহেল (১৪)। সে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার ভাটিয়াপাড়া এলাকার আলম মিয়ার ছেলে।
শিশুটির বাবা আলম মিয়া ও স্বজনেরা জানান, সংসারের অভাব অনটনের কারণে স্বপরিবারে গাজীপুরে আসেন তিনি। পূবাইল থানাধীন ওই কারখানার পার্শ্ববর্তী পোড়ান টেক এলাকায় একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। তার সন্তান সোহেল স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণীতে পড়তো। আলম মিয়া এলাকায় রিক্সা চালান এবং তার স্ত্রী আজিয়া বেগম স্থানীয় একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। স্থানীয় মাস্টার সিমেক্স লিমিটেড কারখানার ম্যানেজার রফিক ছিলেন আলম মিয়ার রিক্সার নিয়মিত যাত্রী। রফিকের পরামর্শে ও সহযোগিতায় সংসারের অভাব ঘোচাতে গত দুই মাস আগে ছেলে সোহেলের লেখাপড়া বন্ধ করে ওই কারখানায় অফিস সহায়কের চাকরি দেন। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ অফিসের কাজের পরিবর্তে শিশু সোহেলকে দিয়ে প্রায়শঃ মেশিনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করাতো।
আলম মিয়া জানান, কারখানাটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষাবোর্ড এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বইপুস্তক ও প্রশ্নপত্র ছাপানো সহ নিয়মিত বিভিন্ন প্রকাশনার কাজ করে থাকে। নরসিংদীতেও একই কারখানার আরেকটি সচল ইউনিট রয়েছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার দিন গত ৮ জুলাই সন্ধ্যায় ইসমাইল হাসান সোহেল ঝুঁকিপূর্ণকাজে ভারি মেশিন চালাতে অপারগতা প্রকাশ করায় সোহেলকে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত মেশিনের ওপর ফেলে দেয়া হয়। এতে তাৎক্ষনিক তার ডান হাতের কব্জি ও বাম হাতের চারটি আঙ্গুল মেশিনে কাটা পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারখানার কর্মচারিরা তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করে। খবর পেয়ে আমরা হাসপাতালে গিয়ে সোহেলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষ শিশু সোহেলের চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা করেনি, এমনকি তার কোন খোঁজ খবর নেয় নি। এ ঘটনায় পূবাইল থানায় মামলা করতে গেলে তৎকালীন ওসি মামলা গ্রহন করেন নি। অবশেষে ১৬ জুলাই গাজীপুরের আদালতে মামলা করি। আদালত অভিযোগটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য মহানগর ডিবি’তে পাঠিয়েছে। কিন্তু কারখানার প্রভাবশালী মালিক মামলাটির তদন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে এবং মামলাটি তুলে নিতে নানাভাবে চাপ দিচ্ছে ও হুমকি দিচ্ছে।
সোহেলর মা আজিয়া বেগম বলেন, ছেলের চিকিৎসা করাতে আমাদের প্রায় দেড় লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে। এখনো কারখানা কর্তৃপক্ষ তার খোঁজ খবর নেয়নি। আমরা ফ্যাক্টরিতে গেলে ঢুকতে দেয়া হয় না। এমনকি আমার ছেলের মোবাইল ফোনটাও তারা এখনো ফেরত দেয় নাই। তিনি আরো বলে, আমার ছেলে জীবনের জন্য স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। আজীবন তাকে অন্যের সাহায্য নিয়ে চলতে হবে। খাওয়া দাওয়া, গোসল, প্রশ্রাব-পায়খানা, কাপড় পড়াসহ প্রায় সবকাজ অন্যের সাহায্য ছাড়া করতে পারবে না।
এব্যাপারে কারখানার ম্যানেজার (এডমিন) ইয়াদি আমিন সুমন দাবী করেন, মাস্টার সিমেক্স পেপার লিঃ কারখানায় এধরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজীপুর মেট্রোপলিটন ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর জাহিদুল ইসলাম এবিষয়ে বলেন, আমি তদন্ত করতে কারখানায় গিয়েছি। সেখানে মাস্টার সিমেক্স পেপার লিঃ এর ম্যানেজার (এডমিন) ইয়াদি আমিন সুমনসহ অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।