গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে ভোট যুদ্ধের লড়াইয়ে শেষ হাসি হেসেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী (টেবিল ঘড়ি) জায়েদা খাতুন। রাজনীতিবিদ না হয়েও তিনি একজন গৃহীনি হয়ে প্রতিপক্ষ ঝানু রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী (নৌকা) মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. আজমত উল্লা খানকে পরাজিত করেছেন এ নির্বাচনে। নির্বাচনে অংশ নিতে জায়েদা খাতুনের ছেলে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমও মেয়র পদে মনোনয়ন পত্র জমা দেন। কিন্তু তার মনোনয়ন পত্র বাতিল হয়ে যায়। সেইসঙ্গে আওয়ামীলীগ থেকে আজীবনের জন্য দ্বিতীয় দফায় বহিষ্কার করা হয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলমকে। এর প্রায় ১৮ মাস আগে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তাকে। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষ ঝানু রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মা জায়েদা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামেন জাহাঙ্গীর আলম। নির্বাচনে নেমে তার মা জায়েদা খাতুন ঘোষণা দেন ছেলের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন।
অসম এ নির্বাচনী লড়াইয়ে ভোট কেন্দ্র গুলোতে অধিকাংশেই ছিল না টেবিল ঘড়ি প্রতীকের নির্বাচনী এজেন্ট। নির্বাচনী প্রচারণায় ছিল না তেমন মাইকিং, লিফলেট ও পোস্টার। বাঁধা দেওয়া হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণায়। হামলা ও ভাংচুর করা হয়েছে তাকে বহনকারী গাড়ি। মারধর করা হয়েছে তার কর্মী সমর্থকদের। জাহাঙ্গীর আলম অনুসারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোনঠাসা এবং শায়েস্তা করতে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী বেছে নেয় মহানগর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাদের উপর শোকজ এবং বহিষ্কারাদেশ নীতি। মহানগরের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মন্ডলের স্বাক্ষরে গণহারে শোকজ এবং বহিষ্কারের চিঠি ইস্যু করা হয় জাহাঙ্গীর আলম পন্থীদের। জাহাঙ্গীর ও তার মায়ের বিরুদ্ধে ছড়ানো হয় নানা অপপ্রচার ও গুজব। জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর চোখে পড়ার মতো তেমন কোন উন্নয়ন কাজ হয়নি গাজীপুর সিটিতে। ফলে এসব ঘটনায় প্রতি মুহুর্তে ভোটারদের সমর্থন ও ভালবাসা এবং সিমপ্যাথী (সহানুভুতি) বাড়তে থাকে জাহাঙ্গীর ও তার মায়ের প্রতি। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও তার বাইরেও রয়েছে জাহাঙ্গীরের একটি নিজস্ব বলয়। হয়রানী, নির্যাতন, শোকজ, বহিষ্কারের শিকার এসব নেতাকর্মীরাই সময় মত বুকে নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে ভোট দিয়ে সুযোগের প্রতিশোধ নিয়েছেন নৌকা মার্কা ফেল করিয়ে। যার প্রতিফলন ঘটেছে বৃহষ্পতিবারের নির্বাচনে। ভোটরদের নীরব ভোটে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। অনেকটা ছেলের কাঁধে ভর করে ও ভোটারদের সিমপ্যাথী এবং প্রতিশোধের ভোটে তিনি এ নির্বাচনে বিজয়ী হন স্পষ্ট ভোটের ব্যবধানে। তিনি হলেন নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীর পর দেশের দ্বিতীয় নারী সিটি মেয়র।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগে গত ১৯ নবেম্বর গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়াামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। একইসঙ্গে দলে তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে মেয়র পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পরে তাকে ক্ষমা করে দলে ফেরানো হলেও এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। দলের মনোনয়ন না পাওয়া, নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারার পর জাহাঙ্গীর তার মাকে প্রার্থী করায় ‘কিছুটা সহানুভ’তিও’ পেয়েছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সাদা চোখে হিসাবটা এমন মনে হলেও জায়েদা খাতুনের নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন অনেকেই। তবে সেটি ব্যক্তি জায়েদা খাতুনের কোনো ক্যারিশমার কারণে নয়, বরং তার ছেলের কারণে।
স্থানীয়দের মতে, নৌকায় নৌকায় বিশ্বাস ঘাতকতার ভোটের এমন নীরব বিপ্লবে এখন হতাশ আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও শীর্ষ নেতৃত্ব। নানা ঘটনায় আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মেয়র পদ হারানো ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হয়ে আবার পুনরায় আওয়ামী লীগে ফিরিয়ে আনা, জাহাঙ্গীর আলমের সিটির আওয়ামী লীগের নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন বাতিল হওয়া এবং মাকে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী করা, এমন সব কর্মকান্ডে জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর সিটি ছাড়িয়ে সারাদেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনায় আসেন। এছাড়া মাকে নিয়ে গাড়ি বহরে নির্বাচনী প্রচারণায় এসে টঙ্গীতে বার বার বাঁধার সম্মুখীন হয়ে গাড়ি ভাংচুর ও হামলার শিকারেও আলোচনায় এবং মানুষের ভালবাসা কাড়েন জাহাঙ্গীর আলম। মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল এবং মেয়র পদ থেকে বহিষ্কারের পর গাজীপুর টঙ্গীতে জাহাঙ্গীর আলম অনুসারী বহু নেতাকর্মীকে নির্দয়ভাবে গণ শোকজ, বহিষ্কারের চিঠি দেয়ায় গাজীপুর সিটি নির্বাচনে এর প্রতিশোধ নেয় এসব ভুক্তভোগী নেতাকর্মীরা। এছাড়াও নির্বাচনের ৪/৫ দিন আগ থেকে জাহাঙ্গীর আলম সম্পৃক্ততায় টঙ্গী এবং টঙ্গীর বাইরের নানা মামলায় গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয় আওয়ামী লীগের বহু নেতা কর্মীকে। এসব নেতাকর্মী এবং আত্মীয়স্বজনরা একত্রিত হয়ে ক্ষোভ ঢালেন সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাহ খাঁনের বিরুদ্ধে জায়েদা খাতুনকে ভোট দিয়ে।
গাজীপুরে আওয়ামী লীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কারের পর স্থানীয় আওয়ামীলীগ স্পষ্টতঃ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। নেতাকর্মীদের একটি অংশ চলে যান সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে। যারা জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষ অবলম্বন করেন তাঁদেরকে কোনঠাসা করতে মূল আওয়ামী লীগ শোকজ, বহিষ্কার নীতি গ্রহন করে। আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগ স্বেচ্ছাসেবকলীগেও চলে একই কার্যক্রম। এতে দেখা দেয় একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস। একপর্যয়ে কোনঠাসা হয়ে পড়েন জাহাঙ্গীর আলম পন্থীরা। এসব নেতা কর্মীদের বিভিন্ন কার্যক্রমে অবমূল্যায়ন করতে থাকে মূল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে জাহাঙ্গীর আলম অনুসারীদের। এসব নেতাকর্মীদের ব্যপাওে পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন যাত্রায়ও দেখা দেয় আওয়ামী লীগের কোনঠাসা নীতি। জাহাঙ্গীরপন্থী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এমন পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করায় এসব নেতাকর্মীরা নৌকা মার্কায় ভোট না দিয়ে ঘড়ি মার্কায় ভোট দিয়ে মধুর প্রতিশোধ নেয় জাহাঙ্গীর পন্থীরা। তারা নৌকা প্রতীকের ব্যাজ গলায় ঝুলিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে জায়েদা খাতুনের টেবিল ঘড়ি প্রতীকে ভোট দেয়। একইসঙ্গে অন্যদেরকেও টেবিল ঘড়ি প্রতীকে ভোট দিতে উৎসাহিত করে, যার অনুমান করতে পারেন নি নৌকা প্রতীক প্রার্থীর নেতৃবৃন্দ। ফলে সিটি নির্বাচনে বাজিমাত করতে সহজ হয়েছে জাহাঙ্গীরের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের।
নির্বাচিত হয়ে যা বললেন জায়েদা খাতুন ॥
জায়েদা খাতুন বলেন‘গাজীপুরবাসীকে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান। তিনি, আমি উনাকে (প্রধানমন্ত্রী) ধন্যবাদ জানাই। ভোটটা আমার সুষ্ঠু হয়েছে। আমি আমার ভোটের হিসাব পেয়েছি।’
সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জায়েদা খাতুন বলেন, ‘এই বিজয় আমি গাজীপুরবাসীকে এবং প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেব। গাজীপুরবাসীর ঋণ আমি শোধ করার চেষ্টা করব। আপনারা (সাংবাদিকরা) আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, আপনাদের কাছেও ঋণ আছে। আপনারা যখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তখন আমার আশেপাশে কেউ ছিল না। আমি গাজীপুরের কাজ করেই ঋণ শোধ করব। কাজটা যেহেতু আমি একা করতে পারব না। তাই আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে করব।
তিনি আরো বলেন, আমার ছেলেকে সত্য প্রমান করার জন্যই ভোটে আসা। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শহরের উন্নতির জন্য, আমার ছেলে, শহরের মানুষ সবাইকে সাথে নিয়েই কাজ করব। দরকার পড়লে আজমতউল্লা খানেরও মতামত নেব।