গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের এবারের নির্বাচন বেশ জমে উঠেছে। প্রতিদিনই প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকরা রোদ বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সকাল হতে রাত পর্যন্ত ব্যাপক উৎসব মুখর পরিবেশে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বসে নেই তাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীরাও। তারা শহরের অলিগলি, হাট-বাজার, দোকান, মিল-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠাণসহ প্রতিটি এলাকা ঘুরে ঘুরে ভোটারদের কাছে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন।
গাজীপুরের এ নির্বাচনে এখন ভাসমান ভোটাররা মূল ফ্যাক্টর। তাদের ভোটে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের ভাগ্য অনেকটা নির্ধারিত হবে। নির্বাচনে তাদের ভোট অনেকটা প্রভাব ফেলবে। নগরীর মোট ভোটারদের একটি বড় অংশ এসব ভাসমান ভোটার। এসব ভোটাররা গাজীপুরের বাইরের অন্য এলাকা থেকে এখানে এসে বিভিন্ন মিল-কারখানায় ও প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন এবং ভোটার হয়েছেন। এদের অধিকাংশই নগরীতে ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। তাই এসব ভাসমান ভোটারদের গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকরা তাদের কাছে প্রতিদিন ছুটে যাচ্ছেন এবং সমর্থন ও ভোট আদায়ের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারে সহযোগিতা করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অন্ততঃ ডজন খানেক কেন্দ্রিয় নেতা প্রতিদিন গাজীপুরে আসছেন গণসংযোগ করতে। এ নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় সংসদসহ আগামি নির্বাচনগুলোতে অনেকটা প্রভাব ফেলবে এমন ধারনায় এ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা প্রতিদিন গাজীপুরে ভিড় জমাচ্ছেন। তারা গ্রামে বা হাট-বাজারে গিয়ে খেটে খাওয়া সাধারন মানুষের সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলছেন ও একত্রে ঘুরছেন, এমন কি ছোট দোকানের বেঞ্চে বসে চা’ পান করছেন। নির্বাচনের কারণে হলেও যেন এসব ভিআইপি নেতাদের কাছে শ্রমিক ও সাধারন মানুষের কিছুটা সময়ের জন্য কদর বেড়েছে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের পদচারনায় গাজীপুরের শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এখন মুখরিত হয়ে উঠেছে।
এদিকে নগরবাসীর জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা নিশ্চিত, বিশেষজ্ঞ কমিটি, নগর সরকার, দূষণ নিয়ন্ত্রন বোর্ড, জাকাত বোর্ড গঠন করা সহ ৩৪ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাত পাখা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান। মেয়র পদে নির্বাচিত হলে তিনি ইশতেহারে থাকা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গাজীপুরকে একটি উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মানবিক শান্তির নগরী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতি দেন। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর এই প্রথম কোনো প্রার্থী ইশতেহার ঘোষণা করলেন।
প্রার্থীদের গণসংযোগ ॥
আওয়ামীলীগ ॥ আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী (নৌকা) এড. আজমত উল্লা খান বুধবার সকাল হতে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে মহানগরীর কোনাবাড়ি থানার বাইমাইল, জরুন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় জেলখানা রোড, নছের মার্কেট সহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। এসময় তিনি একাধিক পথসভায় বক্তব্য রাখেন। গনসংযোগের ফাঁকে তিনি স্থানীয় ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দলের নেতা কর্মীদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। এদিকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব মোঃ মতিউর রহমান জানান, বুধবারেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও নৌকা প্রতীকের প্রধান সমন্বয়ক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগাঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম সহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা গাজীপুরে এসে দিনভর নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী এড. আজমত উল্লা খানের পক্ষে টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। এসময় তাদের সঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মন্ডল, নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব মোঃ মতিউর রহমানসহ আওয়ামীলীগ ও অঙ্গসংগঠণের সকল পর্যায়ের নেতা কর্মীরাসহ আশেপাশে এলাকার নেতা কর্মীরাও অংশ নেন। এসময় বিভিন্ন এলাকায় একাধিক পথসভা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে নির্বাচনী আচরণের বিধি নিষেধের কারণে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আকম মোজাম্মেল হক এমপি, যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ এমপি সহ জেলার অন্য সংসদ সদস্যরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারণা ও গণসংযোগে অংশ না নিলেও সার্বক্ষনিক খোঁজ খবর রাখছেন এবং পরামর্শ দিচ্ছেন বলে মতিউর রহমান জানিয়েছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন ॥ টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মেয়র পদে প্রতিদন্ধিতা করছেন সাবেক মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। বুধবারেও তিনি ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরকে সঙ্গে নিয়ে নগরীর ছয়দানা মালেকের বাড়ি এলাকা হতে গণসংযোগ শুরু করেন। পরে তিনি নগরীর রাজেন্দ্রপুর, কাউলতিয়া, পোড়াবাড়ি, সালনা, বাংলাবাজার, তেলীপাড়া, নগপাড়া, মারিয়ালী, জয়দেবপুর ও চান্দনা চৌরাস্তা সহ সদর ও বাসন থানার বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন। এসময় তিনি একাধিক পথসভায় বক্তব্য রাখেন ও ভোটারদের কাছে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে ভোট প্রার্থণা করেন। এরআগে তিনি নগরীর ছয়দানা এলাকায় তার বাসায় কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
জাপা প্রার্থী ॥ জাতীয় পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন (লাঙ্গল) বুধবার মহানগরীর সদর থানা এলাকা হতে নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রম শুরু করেন। পরে তিনি কৃষি গবেষণা ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এলাকাসহ চান্দনা চৌরাস্তা এবং কাশিমপুর থানার বিভিন্ন এলাকায় দিনভর কর্মী সমর্থকদের নিয়ে গণসংযোগ করেন। এসময় তিনি একাধিক পথসভায় বক্তব্য রাখেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র প্রার্থী ॥ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত মেয়র প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান (হাত পাখা) কর্মী সমর্থকদের নিয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। এসময় তিনি একাধিক পথসভায় বক্তব্য রাখেন। এদিন দুপুরে তিনি ৩৪ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। শহরের একটি পত্রিকা অফিসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহ নূর ইসলাম রনি ॥ এদিকে হাতি প্রতীক নিয়ে অপর স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহ নূর ইসলাম রনি বুধবার সকালে কর্মী সমর্থকদের নিয়ে টঙ্গীর এরশাদ নগর এলাকা হতে গণসংযোগ শুরু করেন। তিনি দিনভর গাজীপুরা, উত্তর ও দক্ষিণ খাইলকৈর, ডেগেরচালা, মৈরান, হারিকেন, মালেকের বাড়ি, শরিফপুর সহ গাছা থানার বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন। এসময় তিনি একাধিক পথসভায় বক্তব্য রাখেন।
এখনই সেনা মোতায়েনের মতো পরিস্থিতি হয়নি — স্বতন্ত্র প্রার্থী রনি
গণসংযোগকালে এক পথসভায় তিনি বলেন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ইসির জন্য পরীক্ষা। এখন পর্যন্ত নির্বাচনী পরিবেশ ধরে রাখতে পেরেছে ইসি, চেষ্টাও করছে। তবে সামনের দিনগুলোতে কি হয় সেটি দেখার বিষয়। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এখনই সেনা মোতায়েনের মতো পরিস্থিতি হয়নি। তবে ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে ও ইসির প্রতি ভোটারদের একটু আস্থা ফিরেয়ে আনতে হলে সেনা মোতায়েন প্রয়োজন।
হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থীর ইশতেহার ঘোষণা ॥
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শেষ হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ আগে বুধবার ৩৪ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান।
নির্বাচিত হলে নগরবাসীর জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা নিশ্চিত, বিশেষজ্ঞ কমিটি, নগর সরকার, দূষণ নিয়ন্ত্রন বোর্ড, জাকাত বোর্ড গঠন করবেন বলেও ইশতেহারে উল্লেখ করেন হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী। ৩৪ দফা ইশতেহার তুলে ধরে তিনি ঘোষণা দেন জয়ী হলে নগর ভবন ধনী-গরিব সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর এই প্রথম কোনো প্রার্থী ইশতেহার ঘোষণা করলেন।
নগরবাসীর ভোটে তাকে নির্বাচিত করলে ইশতেহারে থাকা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গাজীপুরকে একটি উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মানবিক শান্তির নগরী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন বলে তিনি ঘোষনা দেন। বুধবার দুপুরে শহরের একটি পত্রিকা কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি ৩৪ দফা কর্মসূচি সংবলিত ইশতেহার নগরবাসীর উদ্দেশে তুলে ধরেন।
ইশতেহারে গাজী আতাউর রহমান বলেন, গাজীপুর নগরীকে যানজটমুক্ত, জলাবদ্ধতা নিরসন, দুর্নীতিমুক্ত নগর ভবন, পরিকল্পিত দুর্ভোগ, স্বজনপ্রীতি, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, নদী দূষণ, পানি সমস্যা সমাধান, নাগরিকদের নিরাপত্তা, ফুটপাত দখলমুক্ত, পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা নিরসন, নগর স্বাস্থ্য প্রণয়ন, ধনী-গরিব সবার জন্য উন্মুক্ত নগর ভবন, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, বাসা ভাড়া প্রণয়ন, ভিক্ষুক, হকার, ছিন্নমূল ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পুনর্বাসন, নারীবান্ধব গণপরিবহণ, সমাজ নিয়ে উন্নয়ন চিন্তা, হকার, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত নগর গড়া, সার্বিক উন্নয়ন করার পরিকল্পনাসহ ৩৪ টি কাজ করবেন। তিনি এই ইশতেহার বাস্তবায়নে নগরবাসীর মতামত নেবেন বলেও জানান।
ইশতেহার ঘোষণাকালে লিখিত বক্তব্যে গাজী আতাউর রহমান বলেন, আপনারা সম্মিলিতভাবে গাজীপুরের সমস্যার সমাধান করতে চাইলে এবং গাজীপুরকে বাসযোগ্য টেকসই, উন্নত, আধুনিক সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে হাত পাখা মার্কায় ভোট প্রার্থনা করেন। যদি সুস্থ পরিবেশে বাঁচার জন্য অশুভ কায়েমি স্বার্থবাদী সিন্ডিকেটকে অবশ্যই ভাঙতে হবে এবং গাজীপুর সিটিকে রক্ষা করতে হবে।
তিনি অরো বলেন, কাউকে ভোট দেওয়া কোনো আবেগ বা দলীয় বিষয় নয়। এটি একটি নৈতিক বিষয়। যাকে তাকে ভোট দেওয়া ইসলাম সম্মতও নয়। ইসলাম, দেশ ও মানবতার জন্য ক্ষতিকর ব্যাক্তিকে ভোট দেওয়া মারাতœক গুনাহের কাজ। দলীয়, আবেগ, ব্যাক্তির প্রভাব, আতœীয় বা প্রতিবেশী হওয়ায় ভোট পাওয়ার যোগ্যতা নয়। তিনিই ভোট পাওয়ার যোগ্য যার দ্বারা সমাজ, মানুষ ও সম্পদ লুন্ঠন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও ক্ষতি হবে না। জবাবদিহীতা নিশ্চিত করতে ওপেন জনগনের মুখোমুখি হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
এ সময় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজীপুর মহানগর সভাপতি ফাইজ উদ্দিন আহমদ, সহ-সভাপতি মাওলানা এম এ হানিফ সরকার, যুগ্ন সম্পাদক অধ্যক্ষ মুফতি শহীদুল ইসলাম, সহকারী সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান, সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম সাইদুর রহমান, প্রচার ও দাওয়া বিষয়ক সম্পাদক এস এস ওয়াহিদুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক, যুব অন্দোলনের মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক হাফেজ মাওলানা আব্দুল হালিম চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।