রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য আর মমতামাখা স্পর্শ কখনই ভুলে যাওয়ার নয়। একজন তরুণ ছাত্রনেতাকে কিভাবে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হতে অনুপ্রাণিত করতে হয়, সেদিন আমি শিখেছিলাম এই মহান নেতার কাছ থেকে। মঙ্গলবার (১৬ মে) বিকেলে পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে নাগরিক সমাজের উদ্যোগে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনা সভায় এ কথা বলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি । এ সময় রাষ্ট্রপতি বলেন, হেলিকপ্টারে করে যখন পাবনায় আসছিলাম তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার সাক্ষাতের স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠছিলো। ১৯৭২ সালে পাবনায় ‘মুজিব বাধ’ এর উদ্বোধন করতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখন আমি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর সম্মানে আয়োজিত জনসভায় স্বাগত বক্তব্য রাখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমার বক্তৃতার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। জনসভা শেষে তিনি যখন হেলিকপ্টারে করে আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। জীবনে প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টারে চড়েছিলাম, তাও বঙ্গবন্ধুর সাথে।
সম্বর্ধনার জবাবে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি। পাবনার আলো-বাতাস, প্রকৃতি-পরিবেশ ও সাধারণ মানুষের সাথে মিলেমিশে আমি বেড়ে উঠেছি। তাই রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগেও আমি আপনাদের ছিলাম, এখনো আমি আপনাদেরই আছি। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে আপনাদের লোক হিসাবেই বেঁচে থাকতে চাই। বঙ্গভবনে অবস্থান করলেও পাবনার কথা মনে আসলেই আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। আমি ১৯৬৭-৬৮ সালে এই কলেজের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। পরে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও সভাপতিও হয়েছিলাম। তখন প্রতিকূল পরিবেশে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে রাজনীতি করতে হয়েছিল। রাজনীতি করার সুবাদেই আমার আদর্শ, আমার নেতা বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার পরিচয় হয়।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতির পিতার নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আমি এই পাবনা শহরে প্রতিরোধ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট আমাকে গ্রেফতার করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে টানা তিন মাস চলে অসহ্য-অমানবিক নির্যাতন। তারপর তিন বছর কারাভোগের পর ১৯৭৮ সালে আমি কারাগার থেকে মুক্তি পাই।
সো. সাহাবুদ্দিন বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয় সেই তদন্তের দায়িত্ব ভার আমাকে দেওয়া হয়েছিল। এটা ছিলো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমার দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কানাডার আদালতে বিশ্বব্যাংকের সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এই চাপ মোকাবিলায় আমার প্রতি পাবনাবাসীসহ দেশবাসীর দোয়া ছিলো বলেই এই কঠিন কাজ আমি সফলভাবে শেষ করতে পেরেছি।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বক্তব্যে বলেন, দেশের রাষ্ট্রপতি হবো এটা কখনো ভাবিনি। কিন্তু ভাগ্য আজ আমাকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছে। আপনাদের দোয়া আর ভালোবাসা ছিলো বলেই আমি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আপনাদের ভালোবাসাকে সঙ্গী করেই নিষ্ঠার সাথে রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব পালন করে যেতে চাই। এজন্য আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা চাই। পাবনা জেলা ও দেশের উন্নয়নে আপনারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর অবদান রাখবেন এটাই আমি প্রত্যাশা করি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে। করোনা মহামারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা প্রভাব থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা ও গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল। মানুষের গড় আয়ু ও জীবযাত্রার মান বেড়েছে এবং বিভিন্ন উন্নয়নসূচকে বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ থেকে ভালো অবস্থায় অবস্থান করছে। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
বক্তব্যের শুরুতেই বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করায় আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া আদায় করেন। সেইসাথে এই পদে মনোনয়ন দেয়ায় গভীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে। আজকের এই আনন্দঘন মুহূর্তে আমি তিনি তার বাবা-মা কে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। আগে কি পেয়েছেন, ১৪ বছরে কি পেলেন। সে বিচার বিশ্লেষণ করবেন৷ বিদ্যুৎ এর পরিবর্তে খাম্বা হয়। দেশের টাকা কোথায় যায়?..। এগুলো খেয়াল রাখবেন। বিশ্বব্যাংককে পুঁজি করে পদ্মা সেতু নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। ৭৫ পরবর্তী সময়ে কাটাছেড়া হয়েছিল সংবিধান। নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল গনতন্ত্র, ভাত্র ভোটের অধিকার। বাংলার মানুষ ভালোবেশে ভোট দিয়ে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনে। একের পর এক দেশের কল্যান আর ভালো কাজে ঈর্ষান্বিত হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে পদ্মা সেতু নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করা হয়। তৈরী করা হয় নানা নাটকীয় কাহিনী। রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন বলেন, দূর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হয়ে সে সময়ে আমি পদ্মা সেতুর দূর্নীতির বিষয় নিয়ে তদন্ত করে এর সত্যতা পায়নি। এমনই নানা অসংগতির কথা তুলে ধরে তিনি পাবনাবাসীকে চোখ কান খুলে সামনের নির্বাচনে প্রস্তুতি নেয়ার আহবান জানান। দেশ বিক্রি করে নয়, দেশের সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে কোন কাজ নয়। ড. ইউনুস ও ১/১১ কুশিলবরা পর্দার অন্তরালে রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের অস্তিত্ব রক্ষা এবং আইনী লড়াই করে সরকারকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করতে পাবনাবাসীর একজন হয়ে কাজ করেছি। আপনারাও আমার মতো এক একটি শক্তি হয়ে পাশে থাকবেন৷
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছোঁয়া পেয়েছি। ৬ বার সাক্ষাত পেয়েছি। তার আদর পেয়েছি। আমি পাবনা শহরের রাস্তা থেকে বঙ্গভবনে গিয়েছি। পাবনার মাটি মাখা ছাত্র রাজনীতি থেকে আজ দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছি। কারাবরণ করেছি, তৎকালীন সেনাবাহিনীর নির্যাতন সহ্য করেছি। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা সহ্য করে আজকের এই সাহাবুদ্দিন চুপ্পু হয়েছি।
তিনি পাবনাবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে পাবনা থেকে ঢাকা সরাসরি রেল চলাচল করবে বলে ঘোষনা দেন।
এর আগে ৩টা ২৪ মিনিটে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন রাষ্ট্রপতি। এসময় দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে কৃতিসন্তানকে বরণ করেন পাবনাবাসী। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতসহ ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে বিকেল ৩টা ২৭ মিনিটে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির সহধর্মিণী ফাস্টলেডি ড. রেবেকা সুলতানা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলামের সভাপতিত্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন, ডেপুটি স্পিকার ও পাবনা-১ আসনের সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকু, পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স, পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান বিশ্বাস, পাবনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন, পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির, নারী সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য নাদিরা ইয়াসমিন জলি, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল রহিম লাল, নাগরিক কমিটির আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু, সদস্য সচিব-১ অধ্যাপক শিবজিত নাগ, সদস্য সচিব-২ আব্দুল মতীন খান এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন, নাগরিক সমাজের যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল মতীন খান।
সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের বক্তারা রাষ্ট্রপতির কাছে পাবনাবাসীর দীর্ঘদিনের বিভিন্ন অপূর্ণ দাবি- দাওয়া তুলে ধরেন। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের শুরুতেই নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বাল্য বন্ধু প্রফেসর শিবজিত নাগ এবং ক্রেষ্ট তুলে দেন নাগরিক সমাজের আহবায়ক স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু, নগরের সোনার চাবি উপহার দেন পৌর মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান।
এদিকে রাষ্ট্রপতির প্রটোকল অফিসার নবিরুল ইসলাম সাক্ষরিত সফরসূচি অনুযায়ী জানা গেছে, সফরের তৃতীয়দিন ১৭ মে বুধবার বেলা ১১টায় পাবনা ডায়াবেটিক সমতি পরিদর্শন, বিকেল ৪টায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতের যাদুঘর, বঙ্গবন্ধু কর্ণার, বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল উদ্বোধন এবং আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। এছাড়া বিকেল ৫টায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বিনোদন পার্ক পরিদর্শন করবেন এবং ১৮ মে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১ টায় সার্কিট হাউজে গার্ড অব অনার গ্রহণ শেষে ১১টা ৪০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন।