‘কালকে গিয়া চার কেজি পাইসিলাম, আজকে গিয়া সাড়ে তিন কেজি পাইসি, বিকেলে আবার জোয়াল (জোয়ার) আইলে যাবো, যাইলে বোঝা যাইবো কী পরিস্থিতি’ কথাগুলো বলছিলেন চাঁদপুর জেলার রনাগোয়াল এলাকার জেলে জামাল মিজি।

জামাল মিজিরা তিন ভাই মিলে নিজেদের নৌকা দিয়ে নদীতে ইলিশ মাছ ধরেন। মার্চ-এপ্রিল টানা দুই মাস নিষেধাজ্ঞার পর গত পহেলা মে থেকে ইলিশ ধরা শুরু হয়েছে। প্রথম দিন ইলিশ ধরতে গিয়েছিলেন মিজি।

মঙ্গলবার (২ মে) তার সাথে ফোনে কথা বলার সময় তিনি এভাবেই বলছিলেন, প্রথম আর দ্বিতীয় দিনের ইলিশ মাছ ধরার অভিজ্ঞতার কথা। মিজি জানান, গতবারের তুলনায় এবার ইলিশের সংখ্যা বর্তমানে একেবারেই কম।

‘ইলিশ মাছ পাওয়াই যায় না, নদীতে গেছি ইলিশ ধরতে, মাছ নাই বললেই চলে। এর আগের বছর পাইসিলাম মোটামুটি ভালই।’

যে ইলিশ এখনো পর্যন্ত তিনি ধরেছেন সেগুলোও আকারে বেশ ছোট। তিনি বলেন, প্রতিবার মাছ ধরতে যেতে নৌকা, তেল, ইঞ্জিন আর সহকারী খরচ মিলে প্রায় আড়াই হাজার টাকা ব্যয় হয়। প্রতিবার এক সাথে ছয় থেকে সাতজন মিলে নৌকায় করে মাছ ধরতে যান তারা। এখন যে হারে মাছ ধরা পড়ছে তা বিক্রি করে পোষাতে পারছেন না তারা।

এছাড়া, ভোলা জেলায়ও ইলিশ আশানুরূপ ধরা পড়ছে না বলে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে খবর পাওয়া গেছে।

বরিশাল জেলার সদর উপজেলায় আব্দুল্লাহ মৎস্য আড়তের মালিক জহির শিকদার বলেন, গত বছর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর প্রথম দিনেই তার আড়তে ৫০ মণ ইলিশ এসেছিল। কিন্তু এবার তিনি সর্বোচ্চ পাঁচ মণের মতো ইলিশ পেয়েছেন।

শিকদার বলেন,‘এ বছর নদীর ইলিশ মাছ নেই বললেই চলে। যে এলাকায় অভিযান থাকে না সেখান থেকেও নদীর ইলিশ পাই আমরা। তবে এ বছরই সবচেয়ে কম মাছ আসলো।’

নদীর ইলিশ ধরা না পড়লেও এরইমধ্যে সাগরের ইলিশ আসতে শুরু করেছে। সাগরে বেশ ভালই ইলিশ ধরা পড়ছে বলেও জানান তিনি।

ইলিশ না পাওয়া স্বাভাবিক?
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যানুযায়ী দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে।

ভোলা ও বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে ইলিশ মাছ কিছুটা কম ধরা পড়ছে। তবে এটা অস্বাভাবিক নয়, বরং বেশ স্বাভাবিক। প্রতি বছরই এই সময়টাতে ইলিশ কম মাত্রায় ধরা পড়ে বলে জানাচ্ছেন তারা।

ভোলা জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, এখন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না এমন অভিযোগ সত্য নয়। বরং ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়, কম পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে।

‘ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, মোটামুটি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।’

ইলিশ ধরার মৌসুম না হওয়ার কারণে বাংলাদেশে মে-জুন মাসে ইলিশ কম ধরা পড়ে। আর এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঘটনা বলেই উল্লেখ করেন এমদাদুল্যাহ।

একই কথা বলছেন বরিশাল জেলার মৎস্য কর্মকর্তারাও। এই জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো: আসাদুজ্জামান বলেন, গত ১০ বছরে এমন সময়ে ইলিশ ধরার তথ্য বিশ্লেষণ করলে এটা সহজেই বোঝা যায়, এই সময়ে ইলিশ ধরার পরিমাণ প্রকৃতিগতভাবেই কম থাকে।

তিনি বলেন, ‘জেলেরা যেটা আশা করে, সে একবার জাল ফেলে ৫০টি ইলিশ পাবে। সেখানে তারা ৫০টি না পাইলে তারা যদি ৩০টি পায়, তখন তারা বলে যে ইলিশ কম পাচ্ছি আমরা।’

ইলিশ কম কেন?
বাংলাদেশে চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র। বিশেষ করে মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর-এগুলো হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট।

চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে।

এ কারণে বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে ইলিশের প্রজনন হয় এমন এলাকায় সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে।

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: আসাদুজ্জামান বলেন, সারা দেশে ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল না। বরং বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর জেলায় ইলিশের মোট পাঁচটি অভয়াশ্রমে সব ধরণের মাছ ধরা বন্ধ ছিল গত দুই মাস।

এসব এলাকায় গত পহেলা মে থেকে মাছ ধরা শুরু হয়েছে। এর বাইরে দেশের অন্য জায়গায় মাছ ধরা নিয়মিতই চলেছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, ইলিশ ধরার মৌসুমে কেমন মাছ ধরা পড়বে তা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। আবহাওয়া ও নদীতে পানির উচ্চতার মতো বিষয়গুলো এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।

ভোলা জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, বর্তমানে ইলিশ মাছ কম পাওয়া যাওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বৃষ্টিপাত কম হওয়া।

বৃষ্টিপাত না হলে ইলিশ মাছের পেটে ডিম আসে না। আর ডিম না আসলে তা ছাড়তে সাগর থেকে নদীতে উঠে আসে না ইলিশ মাছ। যার কারণে জেলের জালেও কম ধরা পড়ে ইলিশ।

‘ইলিশ না শুধু, অন্যান্য মাছের পেটেও ডিম আসার সাথে বৃষ্টিপাতের সম্পর্ক আছে। ওরা (ইলিশ) নদীতে আসেই হলো ডিম ছাড়ার জন্য।’

বাংলাদেশে জুলাই মাসের দিকে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। এ কারণে ওই সময়ে ইলিশ বেশি পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন এই মৎস্য কর্মকর্তা। জুলাই থেকে বাংলাদেশে ইলিশ ধরার মৌসুম শুরু হয় বলেও জানান তিনি।

বরিশাল জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো: আসাদুজ্জামান বলেন, চলতি বছর অগাস্টের শেষ থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করছেন তারা।

বাংলাদেশে জুলাই থেকে ইলিশ ধরার মৌসুম শুরু হলেও তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নানা প্রাকৃতিক কারণে এই মৌসুমে পরিবর্তন আসছে। যার কারণে ইলিশ পর্যাপ্ত পরিমানে পাওয়া যায় অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে।

পরিবেশ ও জলবায়ুর কারণে এমন পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা মো: আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আগে দেশে জানুয়ারি মাসে বা শীতের সময় ইলিশ পাওয়া যেতো না। কিন্তু এখন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যায়।’

চলতি বছর বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৯২ হাজার টন। এরমধ্যে বরিশাল জেলায় ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ হাজার টন। এ বছর এর চেয়ে বেশি ইলিশ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এর আগে ২০২১-২২ বছরে বরিশাল জেলায় ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮ হাজার টন। আর মোট উৎপাদন হয়েছিল ৩৯ হাজার টন।

সূত্র :বিবিসি