আজ বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। আমাদের মনের ভেতরের সব ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে উদ্যোমী হওয়ার প্রেরণা দেয় এই দিনটি। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সার্বজনীন লোকউৎসব। এ দিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। রাজধানী এবং দেশব্যাপী চলে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। চিরাচরিত্র এই চিত্রের খানিকটা ভাটা পড়েছে কয়েক বছরে। করোনার আসার পর থেকে পহেলা বৈশাখের সেই জৌলুশে ভাটা পড়েছে। ছায়ানটের উদ্যোগে রমনা বটমূলের আয়োজন, মঙ্গল শোভাযাত্রা হলেও উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা যেন অনেকটাই হারিয়ে গেছে। কমে গেছে মঞ্চ অনুষ্ঠান, স্থবিরতা শোবিজ অঙ্গনেও। আজকের পহেলা বৈশাখ নিয়েও নেই তেমন কোনো আয়োজন। টিভি চ্যানেলেও নেই বৈশাখের অনুষ্ঠান। দু/একটি চ্যানেল কিছু অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্যোগ নিলেও তা দায়সারাভাবে। টিভি চ্যানেলগুলো এখন ব্যস্ত ঈদের অনুষ্ঠান নিয়ে। এক সময় বৈশাখ নিয়ে অডিও কোম্পানিগুলো গান প্রকাশ করলেও এবারে তারা নিস্তব্ধ। প্রতিষ্ঠানগুলোও বৈশাখ রেখে শুধু ঈদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

দেশের অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জি সিরিজের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বৈশাখ নিয়ে আলাদা আয়োজনে কোনো কিছু প্রকাশ হচ্ছে না জি সিরিজ থেকে। আসলে ঈদ ও পহেলা বৈশাখ নিয়ে একসঙ্গে সব হচ্ছে। পহেলা বৈশাখের এক সপ্তাহ পর ঈদ। এটি সবচেয়ে বড় আয়োজন। এই ঈদকে ঘিরেই মূলত আমাদের পরিকল্পনা। তবে বৈশাখ যে নেই তা নয়। ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে পহেলা বৈশাখ হওয়াই এবার পহেলা বৈশাখ নিয়ে আলাদাভাবে কিছু প্রকাশ হচ্ছে না। এটা সম্ভবও না। ঈদের সঙ্গে পহেলা বৈশাখের কিছু পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে এবং সেভাবেই আমরা কাজ করছি। পহেলা বৈশাখ ও ঈদের গান-নাটক আমরা এক সঙ্গে প্রকাশ করব। দুই উৎসব একসঙ্গে।’ সঙ্গীত অঙ্গনের অন্যতম প্রযোজনা ধ্রম্নব মিউজিক স্টেশন। এই প্রতিষ্ঠান ঈদ নিয়ে কাজ করলেও পহেলা বৈশাখ নিয়ে কিছু করেনি। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ নিয়ে আমরা কোনো কাজ করছি না। আসলে বৈশাখ নিয়ে আগের মতো কাজ কেউ করে না। আগে বৈশাখে অ্যালবাম প্রকাশ হতো। বৈশাখের একটা আনন্দ দেখা যেত। এখন সেটি নেই। এখন একটি বা দু’টি গান প্রকাশ হয়। আর এবার ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে পহেলা বৈশাখ। এই সময়ে বৈশাখ নিয়ে কিছু করা সম্ভব না। দর্শক-শ্রোতাদেরও মন এখন ঈদকে ঘিরে।’ তবে কিছু শিল্পী, দু/একটি প্রতিষ্ঠান সিমিতভাবে উদ্যোগ নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে গত মঙ্গলবার টাইগার মিডিয়ার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ হয়েছে ‘লাল শাড়ি’ সিনেমার একটি গান। ‘রঙে রঙে সঙে সঙে’ শিরোনামের গানটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পহেলা বৈশাখের আনন্দ আমেজ। বন্ধন বিশ্বাসের পরিচালিত এই সিনেমাটি প্রযোজনা করেছেন চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস। এতে অভিনয়ও করেছেন অপু। এতে তার বিপরীতে দেখা যাবে সাইমন সাদিককে। প্রযুক্তির এই সময়ে আবহমান বাংলার প্রাচীন ঐহিত্য পহেলা বৈশাখ ধীর ধীরে মলিন হয়ে যাওয়া নিয়ে তারকারা নানা মন্তব্য করেছেন। এ নিয়ে রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সার্বজনীন লোকউৎসব। এ দিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রম্নটি ও ব্যর্থতার গস্নানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় নববর্ষ। পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মেতে ওঠে দেশ। এটা বাঙালি জাতির সংস্কৃতি। এর সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব জুড়িয়ে আছে। প্রতি বছরই শহর-গ্রাম সব জায়গাতেই এই উৎসব পালিত হয়। আমার কাছে মনে হয় না পহেলা বৈশাখের উৎসব-আয়োজন কমে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে এর প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। বরং বাড়ছে বলে মনে করি। রোজার কারণে আয়োজন একটু হালকা হলেও সব খানেই আগের মতোই পহেলা বৈশাখের আবহ তৈরি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, ছায়ানটসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নানা আয়োজনে আগের মতোই বাংলা নববর্ষকে বরণ করছে। রাজধানীর বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পালিত হচ্ছে পহেলা বৈশাখ।’

অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরী বলেন, ‘আমি ব্যক্তি মোমেনা চৌধুরী একজন মুসলমান। মুসলমান হিসেবে ইসলাম আমার ধর্ম। আমি ধর্মকে বিশ্বাস করি। সেই সঙ্গে আমার নিজস্ব সংস্কৃতিকেও ধারণ করি। পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতির কথা বলে। শেকড়ের কথা বলে। ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির বিরোধ কোথায় আমি বুঝলাম না। ইসলাম ধর্মে তো নিজস্ব সংস্কৃতি পালনে বাধা নেই। সৌদি আরবেও তো ঊলুধ্বনী হয়। ঊলুধ্বনী দিলেই কী ধর্ম শেষ হয়ে গেল? নিজস্ব সংস্কৃতি পালন করলেই কী ইসলাম নিঃশেষ হয়ে যাবে। ইসলাম তো তা নয়। তবে হঁ্যা, সংস্কৃতির নামে অশ্লীলতা ইসলামে নিষিদ্ধ। সভ্য মানুষ হিসেবে এটা আমরাও চাই না। অশ্লীলতা, উগ্রতা আমার একেবারে পছন্দ নয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে তো আজকাল অনেক কিছুই হচ্ছে। এর অবস্থা এতটাই খারাপ যে, এখনই ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া উচিত। অহেতুক সময়কে নষ্ট করে দিচ্ছে ফেসবুক। এর ৮০ ভাগ কাজ হচ্ছে মন্দ। আসলে আমরা অস্থিরতার মধ্যে আছি। অশ্লীলতা-উগ্রতা রেখে শৈল্পিক মনোভাব তৈরি করতে হবে।’ নাট্যকার বৃন্দাবন দাস বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আগের মতো পহেলা বৈশাখ উদযাপন হচ্ছে না করোনা ও রোজার কারণে। করোনায় সম্ভব হয়নি বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে। আর পবিত্র রোজার মাস মুসলমানদের কাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসটি বিশেষ করে আমাদের দেশে ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হয়। এই সময়ে মানুষ আলস্নাহর ইবাদতে সময় বেশি দেওয়ার চেষ্টা করেন। সেই দৃষ্টিকোন থেকে কয়েক বছর ধরে মানুষ পহেলা বৈশাখ সেইভাবে পালন করছে না। আর চ্যানেলগুলোও কেমন যেন বৈশাখের ততটা গুরুত্ব দেয় না। এই সময়ে ঈদের কাজ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে প্রতিটি চ্যানেল। অভিনয় শিল্পী ও নাটকের কলাকুশলীরা এখন ঈদের নাটক নিয়ে মহাব্যস্ত। তবে পহেলা বৈশাখ পালিত হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে মানুষের হাতের মুঠোয় এখন বিনোদন।