ট্রফি এলো বাংলাদেশে। উৎসব হলো। ট্রফি দর্শন হলো। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ছাড়া কারও ওই শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হয়নি। কারণ, বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার ও রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া কারও ওই অধিকার দেওয়া হয়নি। শিরোপা রক্ষণাবেক্ষণেও পরতে হয় গ্লাভস। ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুয়েফ, জার্মানির অলিভার কান, হাঙ্গেরির ফ্রেঞ্চ পুসকাস, পর্তুগালের রাউল গঞ্জালেস কিংবা ইংল্যান্ডের ওয়েন রুনিদের মতো কত কিংবদন্তির শিরোপা ছোঁয়া হয়নি। বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাসে মাত্র ৪৪৫ জন ওই স্বপ্ন ছুঁয়েছেন। বাকিদের গেয়ে যেতে হয়েছে ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি’।
‘একখণ্ড স্বর্ণ’ ছুঁয়ে দেখতে, উঁচিয়ে ধরতে আর চুমু আঁকতেই তো এত কিছু! ওই স্বপ্ন ছোঁয়া হয়নি বলেই ৩৭ বছরে এসেও সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তারুণ্যের কাঁধে জোয়াল না ছেড়ে কাতর চোখে কাতার পানে চেয়ে থেকেছেন। অবসর ভেঙে ফিরেছেন লিওনেল মেসি। ট্রফি হাতে নিতেই উচ্ছ্বাসে চোখ ফেটে কান্না এসেছে। আক্ষেপে কত চোখের পানি ঝরে গেছে নীরবে।
‘মাথায় ডিস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী।’ ১৯৬৬ সালে চুরি হওয়া বিশ্বকাপ কাগজে মোড়ানো অবস্থায় খুঁজে পাওয়া ডেভিড করবেট ওভাবেই বর্ণনা দিয়েছিলেন। যে ট্রফি ১৯৮৩ সালের ২০ ডিসেম্বর চিরতরে হারিয়ে গেছে। রেখে গেছে ইতিহাস-ঐতিহ্য, চ্যাম্পিয়নদের নাম। আর ‘ভি ফর ভিক্টরি’। ১৯৩০ ফিফা বিশ্বকাপের নাম ছিল ভিক্টরি। গ্রিক দেবী নাইকে ছিলেন জয়ের প্রতীক। তাঁর নামে এবং আদলে শিল্পী আবেল লেফলিউর প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফির কাঠামো দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে প্রথমবার ‘হারিয়ে যায়’ শিরোপা।
ফিফার ইতালিয়ান কর্মকর্তা অত্তোরিনো বারাসি রোমের ব্যাংক থেকে ট্রফি সরিয়ে নিজের ঘরে জুতার বাপে লুকিয়ে রেখেছিলেন, যাতে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়া যায়। ১৯৪৩ সালে ভিক্টরির নাম হলো ফিফা প্রেসিডেন্ট ‘জুলে রিমে’র নামে। যিনি ১৯২১-৫৪ সাল পর্যন্ত ফিফার চেয়ারে বসে বিশ্বকাপের পরিকল্পনা, বাস্তবে রূপদান থেকে বিশ্বকাপের বিশালত্ব দিয়েছেন। ১৯৭০ সালে পেলের ব্রাজিল তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতল। উদযাপনের সময় খোয়া যায় শিরোপার সবচেয়ে দামি অংশ মাথার ওই মুকুট বা ডিস, যা স্টেডিয়ামের বাইরে থেকে উদ্ধারও হয়।
কথামতো শিরোপা ব্রাজিলের হয়ে গেল। ফিফার শিরোপা বলে কিছু থাকল না। ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ১৯৭১ সালে নতুন শিরোপার কাজ হাতে নিল। সিদ্ধান্ত নিল, জয়ী দলকে শিরোপা একবারে দিয়ে দেওয়া হবে না। সাত দেশের ভাস্কর্য শিল্পীরা নকশা দেওয়ার সুযোগ পেলেন। ৫৩টি নকশা জমা পড়ল। তবে চূড়ান্ত হয়েছিল ইতালির শিল্পী সিলভিও গাজানিগার নকশা, যিনি সাফল্যকে শিল্পে রূপ দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর হাতে ফিফা বিশ্বকাপও সাফল্যের সর্বোচ্চ নিদর্শনের রূপ পেল। যাতে তিনি দেখিয়েছেন দু’জন ক্রীড়াবিদ পৃথিবীটাকে উঁচিয়ে ধরেছেন, যা ৩৬.৮ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ওজন ৬.১৭৫ কেজি। এর মধ্যে ৫ কেজিই ১৮ ক্যারেটের খাঁটি স্বর্ণ। বর্তমান বাজারে যা বিশ্বের সবচেয়ে দামি শিরোপা। যার নিচে যুক্ত করা হয়েছে একটি পাত। যাতে বিশ্বকাপজয়ী ১৭টি দেশের ও সালের নাম লেখা সম্ভব। নাম লেখার জায়গা ফুরিয়ে যাওয়ায় ২০৩৮ বিশ্বকাপের পর এই শিরোপা অবসরে পাঠানো হতে পারে।
ওজন, উচ্চতা ও মূল্যের বাইরে এই শিরোপার অনেক গল্প আছে। গজানিগাকে মাথায় রাখতে হয়েছিল জুলে রিমের কথা, দীর্ঘদিন ট্রফির আবেদন ধরে রাখা ও বাণিজ্যের কথা। তিনি মনে করতেন, শিল্প মানবিকতা ধারণ করে। তিনি বয়স, বর্ণ-ধর্ম ও জাতীয়তার ঊর্ধ্বে গিয়ে শিরোপার মধ্যে আবেগ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। দু’জন অ্যাথলেট পৃথিবী উঁচিয়ে রেখেছেন, কারণ খেলা হয় দুই দলের। যারা একসঙ্গে খেলে, কিন্তু একে অপরের বিরুদ্ধে। যারা শক্তি, উগ্রতা, সাহস, বৈচিত্র্য, কঠোরতা, গতি, সাফল্য ও অর্জনের প্রতীক। তাঁর মতে, এগুলোই বিশ্বকে আঁকড়ে রেখেছে। এটাই প্রাণের বৈশিষ্ট্য। ততদিনে বিশ্বকাপ টেলিভিশনের যুগে প্রবেশ করেছে। ফিফা চাচ্ছিল এমন একটা ট্রফি, যা দর্শকের চোখে, টিভিতে এমনকি ছবিতে নজরকাড়া হয়।
নকশা জমা দেওয়ার এক মাস পরে ফিফার সুখবর পান গাজানিগা। শুরু হয় নতুন চ্যালেঞ্জ। কাগজে পেনসিলের খোঁচায় তিনি যা এঁকেছিলেন। কাঠ ও প্লাস্টিকে শিরোপার যে অবয়ব দিয়েছিলেন, তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। যে দায়িত্ব তাঁর কর্মরত প্রতিষ্ঠান জিডিই বারটনিকে দেওয়া হয়। মাত্র ১২ জন কর্মীর প্রতিষ্ঠান। যাঁদের সকলের ট্রফিতে টুকটাক হাতের ছোঁয়া আছে। তবে পিয়েত্রো ও আব্দেলকাদের নামের দু’জন তাঁদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, ছোট-বড় হাতুড়ির নিখুঁত ঘা, ঝালাই মেশিনে কেটে, ঘষা-মাজা করে ও নিখুঁত পলিশ দিয়ে প্রস্তুত করেছেন ওই ট্রফি। চোখে লেন্স বসিয়ে করা হয়েছে হাতের কাজ। চকচকে-তকতকে করতে স্বর্ণের পানি, সাদা পানিতে চুবিয়ে রাখতে হয়েছে। দিতে হয়েছে ‘জাপান বার্নিশ’। সব মিলিয়ে প্রায় তিন মাস সময় লেগেছে ট্রফির পূর্ণতা দিতে। ১৯৭৪ সালে যে ট্রফি প্রথম হাতে নেন জার্মানির অধিনায়ক ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। একে একে কিংবদন্তি ম্যারাডোনা, জিনেদিন জিদান, রোনালদো ফেনোমেননরা ওই বিশ্বকাপ ছুঁয়েছেন। কিন্তু গাজানিগার মতে, প্রথম চ্যাম্পিয়ন তো তিনিই।