নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ‘বোইস ডি ভিনসেনস’ পার্কটি আগের মতোই আছে। প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো সেই পার্কের পাশেই স্ত্যাদে পার্সিং স্টেডিয়াম। বহু ঐতিহ্যবাহী দ্বৈরথের সাক্ষী এটি। শুরুতে এ মাঠে শুধু ফুটবলই খেলা হতো। এখন আর আগের অবস্থা নেই। ফুটবল কালেভদ্রে হলেও অন্যান্য খেলা বেশি হয়। প্যারিসের এক কোণে পড়ে থাকায় দেশটির নীতিনির্ধারকদের নজরও আগের মতো নেই। অথচ এই পার্সিং স্টেডিয়ামজুড়ে একটি বিশেষ তারিখ- ১০ মে ১৯২৩ এখনও জ্বলজ্বলে। যে দিন ইউরোপের ফুটবলের দুই শক্তিধর দেশ প্রথমবার মুখোমুখি হয়েছিল। এর মধ্যে কেটে গেছে ৯৮ বছর। ফুটবলে এসেছে কতশত পরিবর্তন, দুই দেশ জিতেছে সোনালি ট্রফি। অনেক আইকনিক স্টেডিয়ামে হয়েছে তাদের রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ। তবু আবার কোনো বিশেষ মঞ্চে দুই দলের দেখা হলে মনে পড়ে ৯ দশক আগের দিনটা, মনে পড়ে সেই ম্যাচেও কতটা উত্তাপ ছিল। ৩০ হাজারের বেশি দর্শক একসঙ্গে গোল বলে চিৎকার দিয়েছিল। হারজিত ভুলে আবার প্যারিস ছেড়েছিল চার্লি বুকান-নরম্যানদের বহর। আজ সেই দুই দল ১৮ বারের মতো মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।
দোহা থেকে যে সৌরভ ছড়াচ্ছে ফুটবল বিশ্বে। আল বায়াতে বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় ম্যাচ। ইউরোপের দুই ফুটবল পরাশক্তি বলে কথা। ম্যাচের আগেই আগুনে উত্তাপের আঁচ। গতির ঝড় তুলতে চায় দুই দলই, যাদের মূল অস্ত্র আক্রমণভাগ। যেখানে খেলার ধরনটাও কাছাকাছি। গতিকে পুঁজি করে দ্রুততম সময়ে প্রতিপক্ষ রক্ষণ গুঁড়িয়ে দেওয়া- এই মন্ত্রে ফ্রান্সের মূল সেনানী কিলিয়ান এমবাপ্পে। আর ইংল্যান্ডের শাকা, হ্যারি কেইন, ফোডেন বেলিংহাম, রাইসসহ আরও কয়েকজন। ফ্রান্সের উসমান দেম্বেলেও কম যান না। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে যেভাবে এগোচ্ছে ফ্রান্স, তাতে ইংল্যান্ডের মূল টার্গেট কিলিয়ানকে ঠেকানো। গ্রুপ পর্ব আর শেষ ষোলোর ম্যাচগুলো দেখে যা বোঝা যায়, এমবাপ্পেকে বেশিরভাগ আক্রমণই বানিয়ে দিয়েছেন হার্নান্দেজ। দিদিয়ের দেশমের দলের অ্যাটাকিং থার্ডের আক্রমণগুলো এই কিলিয়ানকে কেন্দ্র করে। যেখানে শতাংশ করলে এমবাপ্পের পাস দিয়ে ৪৫ ভাগ আর বাকি আক্রমণগুলো হয়েছিল রাইট উইং থেকে কখনও কিংসলে কোম্যান আবার কখনও উসমান দেম্বেলের সৌজন্যে। মাঝমাঠ থেকে হার্নান্দেজ যে সুযোগগুলো তৈরি করে দেন, সেগুলো বেশিরভাগই এমবাপ্পে একাই ডি বক্স ভেঙে জালে পাঠিয়েছেন। আর দেম্বেলে কখনও গ্রিজম্যানকে আবার জিরুদ বা সরাসরি এমবাপ্পের জন্য আক্রমণ তৈরি করে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত দলটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুযোগ তৈরি করা খেলোয়াড় হার্নান্দেজ ও দেম্বেলে। দুজনই ৯টি করে সুযোগ তৈরি করেছেন।
ইংল্যান্ডের আক্রমণগুলো অবশ্য এক বা দুজনকে কেন্দ্র করে হয়নি। শেষ চারটি ম্যাচ বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, অ্যাটাকিং থার্ডের দুই উইং দিয়েই সমানতালে আক্রমণ শানিয়েছে গ্যারেথ সাউথগেটের দল। যেখানে লেফট উইংয়ে কখনও ফোডেন বা জ্যাক গ্রিলিশ আর রাইটে শাকা কিংবা রাশফোর্ড। এই চারজনই ইংল্যান্ডের আক্রমণভাগের মূল মেশিন। তাঁদের সঙ্গে স্ট্রাইকিংয়ে থাকেন হ্যারি কেইন। আর পাঁচজনকে সুযোগ বানিয়ে দিয়ে সহায়তা করেন লুক শ, বেলিংহাম, হেন্ডারসনরা। যার মধ্যে এখন পর্যন্ত চলমান বিশ্বকাপে দলটির সবচেয়ে বেশি সাতবার আক্রমণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন লুক শ। মাঝেমধ্যে ডি বক্সের মাঝখান দিয়ে আক্রমণ শানালেও খুব একটা জোরদার হয়নি। সেজন্য ম্যাচ চলাকালে তাদের স্ট্রাইকার হ্যারি কেইনকে খানিকটা নিচে নামতেও দেখা গেছে।
দুই দলের এমন বিধ্বংসী অ্যাটাক লাইনে আবার গতির যুদ্ধটাও দারুণ জমার কথা। যেখানে এমবাপ্পের সঙ্গে শাকা, লুক শ, রাইসরাও ছুটতে পারেন ঝড়ের বেগে। এ ছাড়া তারুণ্য আর অভিজ্ঞদের নিয়ে গড়া একাদশে সারা মাঠ চষে বেড়ানোর মতো খেলোয়াড়ও দুই দলে কম নেই। গত কয়েকটি ম্যাচের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হেঁটেছেন ইংল্যান্ডের রাইস। সব মিলে ৪৪.৩ কিলোমিটার হেঁটেছেন এই মিডফিল্ডার। ফ্রান্সের মাঝমাঠের সেনসেশন চুয়েমেনিও চমকে দিয়েছেন এরই মধ্যে। পুরো মাঝমাঠ আগলে রাখার পাশাপাশি রক্ষণের শূন্যতাও করেছেন পূরণ। চার ম্যাচে তিনি হেঁটেছেন ৪০.৩ কিলোমিটার। আক্রমণ ও মাঝমাঠের পর রক্ষণভাগেও দুই দলের লড়াইটা বেশ ধুন্ধুমার হওয়ার কথা। সেখানেও তারকার ঝনঝনানি। সব মিলে রাতে ফুটবল মহাযুদ্ধের আগের দামামা সবাইকে নতুন জল্পনার রসদই জোগাবে।