ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করেন না। টাকা ছাড়া কোন নথি দেয় না কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিসের শাহনাজ বেগম। অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি ও হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে এই অফিস সহকারির বিরুদ্ধে। ভূমি অফিসের চৌকাঠ পেরুলেই তিনি জানতে চান কি কাছে এসেছেন। সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষকে নানা কৌশলে দুইদিনের মধ্যে নথি দেবেন বলে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
এ বিষয়ে একাধিক প্রমাণসহ অভিযোগ এসিল্যান্ডের কাছে সেবাপ্রার্থীরা তুলে ধরলে ‘বদলি কিংবা আইনি’ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোন ভূমিকা দেখেননি সাধারণ ভুক্তভোগিরা। ফলে, এ কারণেই ভূমি অফিসের সেবায় হয়রানি বেড়েছে বহুগুণ।
জানা যায়, কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিসে নামজারি, মিসকেসসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ভূমি সংক্রান্ত কাজ করতে গেলে জরিপ কর্মকর্তা, কানুনগো ও নাজিরকে ম্যানেজ করার পাশাপাশি নথি চাইলে অফিস সহকারি শাহনাজ কে ঘুষে ম্যানেজ করতে হয়। না হলে তিন মাসেও নথি পাওয়া যায় না। ফাইল পাওয়া যায় না।
সব মিলিয়ে শাহনাজের সঙ্গে ঘুষের সমঝোতা করলেই মিলছে কাজের নিশ্চয়তা। এদিকে, নাজিরের ঘুষ বাণিজ্যে রয়েছে বাহিরের সংঘবদ্ধ একটি চক্র। যারা ভূমি অফিসের সেবা নিতে আসা লোকজন কে শিকারে পরিণত করেন।
প্রতিবেদকের কাছে ভূমি অফিসে আসা অধিকাংশ ভুক্তভোগীই জানান, হয়রানি আর ভোগান্তি কী- তা এখানে না এলে বোঝা যায় না। অফিসের প্রত্যেক ধাপে ঘুষ দিয়েই ফাইল এসিল্যান্ডের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। এসিল্যান্ড অল্প সময়ে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করলেও একই অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিব্রত অবস্থায় রয়েছে স্বয়ং সহকারি কমিশনার ভূমি।
আরও তথ্য মিলে, এ উপজেলার ভূমি অফিসগুলোতে কাঠ পেন্সিল আর সাংকেতিক সংকেতে ফাইল প্রসেসিং হয়। নতুন এসিল্যান্ড বেশি কড়াকড়ি করায় কৌশল পাল্টিয়েছে অফিসের অসাধু লোকজন। ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তারা বড় বাবুর নামেই আদায় করছেন ফাইল প্রতি মোটা অঙ্কের লেনদেন।
নামজারি ও মিছ মামলার প্রতিবেদনের প্রতিটি পাতায় পাতায় কাঠ পেন্সিলের দাগ ও লেখা। এইচ ও এস অক্ষরের ছড়াছড়ি। ফাইল চলে গোপনে গোপনে।খতিয়ানের তামিল হয় আরও গোপনে। উপজেলায় তামিল হওয়ার আগে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে তামিল হয় খতিয়ান। আবার এমনও আছে, তামিল হয়নি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। উপজেলায় খতিয়ান তামিল। অহরহ ঘটছে এমন কারবার।
অনিয়মের আরও অভিযোগ রয়েছে, ‘চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের তহসিলদার উজ্জ্বল কান্তি দাশ ও জুলধার তহসিলদার আহম্মেদ নুর ও চরলক্ষ্যার তহসিলদার সাজ্জাদ শাহ আমজাদের উপরও। সাধারণ মানুষ এদের কাছ থেকে কোন সেবা পাচ্ছেন না। টাকায় মিলছে অনৈতিক সুযোগ। প্রতিবেদনে উল্টপাল্ট। অনলাইনে খতিয়ান প্রবেশের নামে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এসব ভূমি অফিসের লোকজন। অথচ, খতিয়ানগুলো আগেই সরকার অনলাইনে প্রবেশ করিয়েছেন।
অপরদিকে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলা ভূমি অফিসে সহকারি হিসেবে যোগদান করার পর থেকেই শাহনাজ বেগম নানা অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এর আগে সদরেও একই অবস্থায় ছিল তার। কর্ণফুলীতে এসে বৈধ লেনদেনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে তার শক্তিশালী সিন্ডিকেট ও দালাল চক্র। অবৈধ কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করার জন্য রয়েছে আরও দু’সহায়ক। এদের মধ্যে একজন সকল প্রকার অর্থনৈতিক লেনদেন ও অপরজন মিসকেস দেখেন এবং ওই সংক্রান্ত বিষয়ে অর্থনৈতিক লেনদেন করে থাকেন। নথি গায়েব ও সরবরাহ কাজেও অফিস তাদের দখলে বলে অনেকেই জানান।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, গত কয়েকদিন আগে আসাদুল আমিন নামে এক সেবাপ্রার্থী ইছানগর মৌজার নথির জন্য আবেদন করলে শাহনাজ বেগম দাবি করে বসেন ৭ হাজার টাকা। কিছুতেই তিনি টাকা ছাড়া নকল দিবেন না। তাই বাধ্য হয়ে ৫ হাজার টাকায় দফারফা করে ২ হাজার টাকা নগদে নেন শাহনাজ বেগম। ঘুষ হিসেবে নেন দুটি এক হাজার টাকার নোট। যার অডিও ভিডিও সংরক্ষিত প্রতিবেদকের কাছে। কিন্তু একদিনের কথা বলে ২৫ দিন হয়রানি করেও নথি পাননি সেবাপ্রার্থী। পরে বিষয়টি অভিযোগ করলে ‘এসিল্যান্ড ও নাজির’ দুদিনেই ওই ভুক্তভোগিকে নকল পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
শুধু কি ইছানগরের আমিন ভূক্তভোগি না আরও কেউ রয়েছে। এমন অনুসন্ধানে তথ্য মিলে, শিকলবাহার এলাকার আবুল বশর নামে আরেক সেবা প্রার্থী খতিয়ানের সইমুহুরি নকল তুলতে গিয়ে পড়েন শাহনাজের ঘুষ বাণ্যিজে। তাঁকে এক খতিয়ানের নকল তুলে দেবেন বলে ১ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে নকল সরবরাহ করেনি অফিস সহায়ক শাহনাজ।
বিষয়টি তাৎক্ষণিক ভাবে এসিল্যান্ডকে জানানো হলেও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে অসাধু ওই নারী কর্মচারী। তাহলে কী জেনেশোনেই মিলে মিশেই হচ্ছে লুটপাট। না অন্য কিছু? সাধারণ মানুষের কাছে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আরেক ভূক্তভোগি মোহাম্মদ শাহাজাহান বলেন, ‘উপজেলা ভূমি অফিসে টাকা না দিলে কোন ফাইলে হাত দেন না। টাকা দিলে কাগজ ঠিক থাকে। টাকা না দিলে কাগজ বেঠিক হয়ে যায়। উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসেও একই অবস্থা। এক প্রকার প্রকাশ্যেই ঘুষ বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন অফিসের লোকজন। কর্ণফুলী-আনোয়ারায় ভূমিমন্ত্রীর সারপ্রাইজ ভিজিট চাই আমরা।’
এসব নানা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত অফিস সহায়ক শাহনাজ বেগম বলেন,‘আমি টাকা নিয়েছি সত্য কিন্তু ওসব টাকা গ্রাহকের নথি রেডি করতে যাকে যাকে অফিসে দিতে হয় দিয়ে দিয়েছি। আমাকে এখন এসিল্যান্ড স্যার নথি সরবরাহ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। আপাতত আমি এসব কাজ করছি না। ’
এ বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরী জানান, ‘ভূমি সেবা কাজে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়, এমন কোন কর্মকাণ্ড উপজেলা ভূমি অফিসের কোন রুমেই চলবে না। সবাইকে সেবা দিতে হবে। কারণ এটা ভূমিমন্ত্রী মহোদয়ের এলাকা। কেউ অনিয়ম করলে পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’
তিনি আরও বলেন, গত ৬ মাসে পুরো নতুন নিয়মে অফিসের সব কিছু ডিজিটাল করা হচ্ছে। সব নথি একত্রিত করা হয়েছে। সাল অনুযায়ি সাজানো হয়েছে। সুতরাং সব ধরনের সেবা ঘরে বসেই পাবেন গ্রাহকেরা।