পূর্ব ঘোষিত রংপুরে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ আগামী শনিবার অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশকে সামনে রেখে শুক্রবার ও গণসমাবেশের দিন (শনিবার) পরিবহন ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছে রংপুর জেলা বাস মালিক সমিতি। কিন্তু কোনো বাধাই যেন ঠেকাতে পারছে না বিএনপি নেতাকর্মীদের; বাস বন্ধের আগেই রংপুরে আসতে শুরু করেছেন তারা। আগাম আসা নেতাকর্মীরা নগরীর আবাসিক হোটেল, ছাত্রবাস, আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও নগরীর বাইরে বিভিন্ন উপজেলায় আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে অবস্থান নিচ্ছেন।

বৃহস্পতিবারের মধ্যেই সমাবেশের ৩০ ভাগ লোক রংপুরে প্রবেশ করবেন বলে আয়োজকরা জানাচ্ছেন। তাদের দাবি- পরিবহন মালিক সমিতির ৩৬ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট গণসমাবেশ লোক আসতে বাধা তৈরি করতে পারবে না। এটা শুধু হয়রানিমাত্র। রাজপথ বিএনপির দখলেই থাকবে বলে আয়োজকদের বিশ্বাস।

শনিবার রংপুরে রেকর্ডভাঙ্গা সর্ববৃহৎ গণসমাবেশ করতে চায় বিএনপি। সমাবেশের জন্য জিলা স্কুল মাঠ চেয়ে আবেদন করলেও মহানগর পুলিশ অনুমতি দিয়েছে কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠের। মাঠে মঞ্চ বানানোর কাজও ইতোমধ্যেই শুরু করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আফতাবুজ্জামান নিপ্পন জানান, প্রশাসনিক হয়রানি এবং মহাসড়কে নছিমন করিমন বন্ধের দাবিতে শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) সকাল ৬টা থেকে শনিবার (২৯ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রংপুর বিভাগের সকল জেলা উপজেলায় দূর পাল্লা এবং আন্তঃজেলা সকল ধরনের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে পরিবহন মালিক সমিতি। তিনি দাবি করেছেন, মোটর, ট্রাক মালিক, ট্রাক্টর, কার, মাইক্রোবাস মালিক সমিতি যৌথসভার মাধ্যমে এই ধর্মঘট আহ্বান করেছে। বিএনপির সমাবেশের কারণেই এই ধর্মঘট কিনা এর কোনো উত্তর দেননি তিনি। ধর্মঘটের পক্ষে জেলা মোটর মালিক সমিতির সভাপতি স্বাক্ষরিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে।

গণসমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব হারুন অর রশিদ (এমপি) বলেছেন, পরিবহন ধর্মঘট হবে, এটা কাম্যই ছিল। সরকারের নীতি নির্ধারকরা নিশ্চয়ই সাম্প্রতিক সময়ের তিনটি গণসমাবেশ দেখেছেন, সেখানেও ধর্মঘট দেয়া হয়েছিল। মানুষ নির্বিঘ্নে এসেছে। আমরা মনে করি এই পরিবহন ধর্মঘটের মাধ্যমে রাজপথ সরকার নিজেই বিএনপি এবং জনগনের দখলে দিয়ে দিল। এখন নির্বিঘ্ন রাজপথে দিয়ে মিছিল নিয়ে আসতে পারবে নেতাকর্মীরা। শুক্রবার সকাল থেকেই সেটা বোঝা যাবে। বাইসাইকেল, রিকশা, মোটরসাইকেল এবং হেঁটে এবং নদী সাঁতরিয়ে লোকজন যানজটবিহীনভাবে সমাবেশে যোগ দেবেন বলেও দাবি করেন তিনি।

এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে সমাবেশস্থল কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠ প্রস্তুতির কার্যক্রম সরেজমিনে মনিটরিং করেছেন গণসমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. এজেড এম জাহিদ হোসেন, সদস্য সচিব ও যুগ্ম মহাসচিব হারুন অর রশিদ এমপি, সমন্বয়ক ও বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু।

আহ্বায়ক ডা. এজেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, আমাদের সকল প্রস্তুতি শেষ। মাঠ নিয়ে তামাশার কারণে আমাদেরকে মঞ্চ এবং মাঠ প্রস্তুতের কাজটি করতে দেরি হয়েছে। তবুও আমরা আশা করি কাল দুপুরের মধ্যেই মঞ্চসহ মাঠ তৈরি হয়ে যাবে। এরই মধ্যে যারা আসবেন তারা মাঠেই অবস্থান নেবেন।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, সরকার পুলিশ দিয়ে বিভিন্নভাবে নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করছে। মামলা, হামলা, গ্রেফতারের হুমকি দিচ্ছে। বাজারে বাজারে মোড়ে মোড়ে গিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এই আতঙ্কই সরকারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত আতঙ্ক তৈরি করা হবে, তত লোকের উপস্থিতি বেশি।

এদিকে সমাবেশ প্রস্তুত কমিটির সমন্বয়ক এবং বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু জানান, আমরা সমাবেশের জন্য রংপুর জিলা স্কুল মাঠের জন্য আবেদন করেছিলাম প্রায় সোয়া মাস আগে। সে অনুযায়ী আমরা পোস্টারিংসহ প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছি। কিন্তু অন্তিম মূহুর্তে রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার আমাদের গণসমাবেশের জন্য কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে মৌখিক অনমুতি নিশ্চিত করেছে। আমরা প্রশাসনের প্রতি সম্মান জানিয়ে কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে মঞ্চ তৈরিসহ অন্যান্য প্রস্তুতির কাজ চালাচ্ছি। এখানে আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ২০০ স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। একটি পরিচ্ছন্ন বিশৃংখলাবিহীন জন-সমুদ্রের সমাবেশ নিশ্চিত করতে চাই আমরা। সেজন্য সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এর আগে আমরা একমাস ধরে রংপুর বিভাগের একটি সিটি করপোরেশন, আট জেলা, ৫৮টি উপজেলা ৩৪টি পৌরসভা এবং ৫৩২টি ইউনিয়নে সম্মেলন সফল করতে দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে বৈঠক করেছি।

সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির এই সমন্বয়ক আরো বলেন, একটি পরিচ্ছন্ন এবং রেকর্ডভাঙা উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। এর আগে অন্তত রংপুরের কোনো সমাবেশে এত লোক হয়নি, এ পরিমাণ লোক উপস্থিতির টার্গেট আমাদের। আমরা নিশ্চিত করেছি শুধু বিএনপি নেতাকর্মী নয়, তৃণমূল, নগর, শহর এবং বন্দরের সাধারণ মানুষরাও এই কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। সমাবেশস্থল ছাপিয়ে মানুষের স্রোত রংপুর মহানগরীর প্রধান সড়ক, বিভিন্ন মাঠসহ অলিগলিতে ভরে যাবে বলে দবি করেছেন তিনি।

দুলু বলেন, জিলা স্কুল মাঠে অনুমতি না দেয়ার মাধ্যমে সরকার এবং প্রশাসন বার্তা দিয়েছে তারা আমাদের গণসমাবেশ বাধাগ্রস্ত করার পাঁয়তারা করছেন। হয়তো সেদিন পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে সরকার ধর্মঘট পালন করবেন। কিন্তু মানুষের স্রোত ঠেকাতে পারবে না সরকার। সকল ধরনের বাধা অতিক্রম করে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ গণসমাবেশে উপস্থিত হবেন। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চাই, কিন্তু সরকার যদি বাধা দেয় তাহলে সেই বাধা প্রতিহত করা হবে।

গণসমাবেশের সভাপতি রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু জানান, প্রশাসন জিলা স্কুল মাঠের অনুমোদন দেয়নি ভয়ে। তবে সেটি দিলেই পরিস্থিতি ভালো থাকতো। পুলিশ চীনের প্রাচীর দিলেও মানুষের স্রোত আটকাতে পারবে না। ইতোমধ্যেই সমাবেশস্থলের লোকজন বিভিন্ন জেলা থেকে আসতে শুরু করেছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। শুধু নেতাকর্মী নয়, সাধারণ মানুষই বেশি আসবেন বলে দাবি তার। শুক্রবার সন্ধ্যার মধ্যেই সমাবেশের প্রায় ৩০ ভাগ লোক নগরী এবং আশেপাশে বিভিন্নভাবে এসে পৌঁছবেন। তারা মাঠে অবস্থান নেবেন। আমরা আশা করছি রংপুর মহানগরীর মূল ১৬ কিলোমিটার এলাকার অলিগলি মানুষে মানুষে টইটম্বুর হবে।

সন্ধ্যায় নগরীর পায়রা চত্বর এলাকার একটি হোটেলে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় এ ধরনের অন্তত ১০ জন বিভিন্ন বয়সী মানুষের সাথে। এদের মধ্যে ৪ জন কুড়িগ্রামের রৌমারির, ৩ জন পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ার, ১ জন ঠাকুরগাওয়ের রানীশংকৈল এবং ২ জন দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বাসিন্দা। তাদের ২ জন আবাসিক হোটেল, ৩ জন আত্মীয় বাড়ি এবং ৫ জন বিভিন্ন ছাত্রাবাসে উঠেছেন। আগাম আসার ব্যাপারে তারা সবাই মোটামুটি একই ধরনের কথা বলেছেন। তাদের দাবি, যদি গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ থাকে, পথে বাধা দেয়া হয়, মারামারি হয়। তাহলে তো আসতে পারবো না। এজন্য আগেই আসা।

বৃহস্পতিবার দিনভর কালেক্টরেট মাঠে সরেজমিনে অবস্থান করে দেখা গেছে আগাম আসা নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে। শুধু নগরী নয়, আশেপাশের উপজেলাগুলোতেও আগাম আসা শুরু করেছেন অনেকেই। উঠেছেন আত্মীয়র বাড়িতে। যাতে হেঁটে হলেও সমাবেশস্থলে আসা যায়। টার্মিনাল এলাকায় কথা হয় ২ জন মধ্যবয়সী যুবকের সাথে। তারা জানালেন, বিএনপির সমাবেশ উপলক্ষে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকে এসেছেন। উঠেছেন বদরগঞ্জের গোপালপুরের শ্যামপুরে আত্মীয়ের বাড়িতে। বিকেলে রংপুর শহর ঘুরে দেখার জন্য আসছিলেন তারা।

রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার নুরে আলম মিনা বিপিএম (বার) পিপিএম জানান, বিএনপির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠের অনুমতি দেয়া হয়েছে। জিলা স্কুল মাঠ না দেয়ার ব্যাপারে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি। সম্মেলন উপলক্ষে বিএনপিকে বাধা দেয়ার অভিযোগটিও সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন তিনি।

রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আবদুল আলীম মাহমুদ জানান, নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি এবং বাজারে বাজারে গিয়ে আতঙ্ক তৈরির বিষয়টি সঠিক নয়। মূলত পুলিশ পুরো বিভাগজুড়ে দেখছে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি। তবে কেউ যদি সমাবেশে যাওয়ার নামে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি করার চেষ্টা করে, তাহলে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে।