গাজীপুরে ডাকাতির পর তাকওয়া পরিবহনের যাত্রীবাহী একটি চলন্ত বাস থেকে স্বামীকে ফেলে দিয়ে এক গৃহবধুকে গণধর্ষণের ঘটনায় চালক ও হেলপারসহ গ্রেফতারকৃতরা রবিবার আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এদিকে ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা দুপুরে সম্পন্ন হয়েছে। পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত মিলেছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।
রবিববার বিকেলে গাজীপুরের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ তার কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, চলন্ত বাসে এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৫জনকে পুলিশ ১২ ঘন্টার ব্যবধানে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত পাঁচজনই রবিবার বিকেলে গাজীপুরের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের মধ্যে সজীব ও শাহীন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ইখলাস উদ্দিনের কাছে, রাকিব মোল্লাহ ও সুমন হাসান জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ইসরাত জেনিফার জেরিনের কাছে এবং সুমন খান জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক জুবাইদা নাসরিন বর্নার কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আর ভিক্টিম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রিফাত আরা সুলতানা এর আদালতে (২২ধারায়) স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে বিচারকের নির্দেশে গ্রেফতারকৃতদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে ধর্ষণের শিকার ওই গৃহবধূকে শনিবার রাতে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা ও ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ভর্তি করা হয়। রবিবার দুপুরে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষ হয় বলে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ডা: এ এন এম আল মামুন জানিয়েছেন। হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার সানজিদা হক ভিক্টিমের ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করেন বলে জানান ওই চিকিৎসক।
হাসপাতালের চিকিৎসক ডা: এ এন এম আল মামুন জানান, প্রাথমিকভাবে পরীক্ষায় ভিক্টিমের ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। তারপরও ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভিকটিমের ডিএনএ পরীক্ষা জন্য আলামত ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ভিকটিমের কপালে একটি আঘাতের চিহ্ন থাকায় তার মাথার এক্সরে করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
গাজীপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন জানান, নওগাঁয় আত্মীয়ের বাড়ি বেড়ানোর শেষে উক্ত নারী স্বামীর সঙ্গে বাসে করে শুক্রবার দিবাগত রাতে গাজীপুরে আসেন। শনিবার ভোররাত সোয়া ৩টার দিকে তারা গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া বাইপাস মোড়ে বাস থেকে নামেন। তারা ময়মনসিংহের ভালুকা থানাধীন স্কয়ার মাষ্টারবাড়ী যাওয়ার উদ্দেশ্যে সেখান থেকে তাকওয়া পরিবহনের একটি বাসে উঠেন। বাসটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা মোড়ে এসে পৌছলে সকল যাত্রীকে বাস থেকে নামিয়ে দেয় চালক ও হেলপার। এসময় অপর একটি বাসের আরো তিন শ্রমিকসহ মোট ৬জন ওই বাসে ছিলেন। পরে ওই নারী ও তার স্বামীকে নিয়ে বাসটি শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পথে হেলপার ও তার সহযোগিরা ওই নারী ও স্বামীর কাছ থেকে মোবাইল, নগদ সাড়ে ১০হাজার টাকা, ব্যাগ ও খাবার সামগ্রীসহ মালামাল ছিনিয়ে নেয়। তারা ওই গৃহবধূর স্বামীকে বাসের ভিতর মারধর করে। এক পর্যায়ে বাসটি মাওনা চৌরাস্তা এলাকার ফ্লাইওভারে উঠার পর আহত স্বামীকে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে তার স্ত্রীকে নিয়ে বাসটি সামনের দিকে যেতে থাকে। কিছুদুর গিয়ে বাসটি ইউ টার্ন নিয়ে পুনঃরায় চান্দনা চৌরাস্তার দিকে রওনা হয়। এসময় গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর আসা পর্যন্ত বাসে থাকা ৬জনের মধ্যে চালক ও হেলাপারসহ ৫ ব্যক্তি ওই নারীকে জোরপূূর্বক পালাক্রমে ধর্ষন করে। অপরজন শিশু হওয়ায় সে বাসের পেছনের সিটে ঘুমিয়ে ছিণ। বাসটি গাজীপুর মহানগরের রাজেন্দ্রপুর এলাকার ভাওয়ালগড়ের নির্জন জায়গায় বাসটি পৌঁছালে ১শ’ টাকা হাতে দিয়ে ওই নারীকে নামিয়ে বাসটি নিয়ে চান্দনা চৌরাস্তার দিকে চলে যায়। পরে ওই নারী হোতাপাড়া এলাকাস্থিত জয়দেবপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ঘটনা জানায়। পরে জয়দেবপুর থানা পুলিশ বিষয়টি উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা ও শ্রীপুর থানা পুলিশকে অবহিত করে। এ দম্পতি ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানাধীন স্কয়ার মাস্টার বাড়ি এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। তার স্বামী একজন পোশাক শ্রমিক এবং ভিক্টিম একজন গৃহিনী।
তিনি আরো জানান, এ ঘটনায় ওই নারীর স্বামী (আনোয়ার হোসেন) বাদী হয়ে ঘটনার পরদিন শনিবার সকালে গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। এ ঘটনার ১২ ঘন্টার মধ্যে জেলা পুলিশের একাধিক টিম যৌথভাবে সড়কের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ৫ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এদের মধ্যে বাসসহ দুই ধর্ষককে গাজীপুর মহানগরের চান্দনা-চৌরাস্তা এলাকা থেকে এবং শ্রীপুরের কদমতলী এলাকার রাসেল মিয়ার ভাড়া বাড়ি থেকে অপর ৩জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে লুণ্ঠিত সকল মালামাল ও তাকওয়া বাসটি জব্দ করা হয়েছে। উদ্ধার মালামালের মধ্যে একটি বাটন মোবাইল, ভ্যানিটি ব্যাগ, ১০ হাজার ৫শ’ টাকা, ট্রাভেল ব্যাগ ২টি, চাউল ২ কেজি, ১/২ কেজি ভুট্টা, ২৫০ গ্রাম পোলাও এর চাউল, এটিএম কার্ড ১টি, এক বয়ম আমের আচার।
গ্রেফতারকৃতরা হলো নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজার থানার দড়িপাড়া গ্রামের আলী আকবরের ছেলে রাকিব মোল্লা (২৩), নেত্রকোনা জেলা সদর উপজেলার গুপিরঝুপা গ্রামের মৃত সানোয়ার হোসেনের ছেলে সুমন খান (২০), ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কাঁঠালকাচারি গ্রামের মৃত কফিল উদ্দিনের ছেলে মোঃ সজিব (২৩), একই জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার বিলডোলা গ্রামের তুলা মিয়ার ছেলে মোঃ শাহীন মিয়া (১৯) এবং খুলনার রূপসা উপজেলার খান মোহাম্মদপুর এলাকার মৃত নূর আলমের ছেলে মোঃ সুমন হাসান (২২)।