এই সিন্ডিকেটের কারণেই বছরের পর বছর ঝুলে আছে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রম বাজার মালয়েশিয়া। শত চেষ্টা করেও শক্তিধর সিন্ডিকেটের বলয় থেকে বের হওয়া আজও সম্ভব হয়নি। এমন কি মৃত্যুর পরও প্রবাসীদের সিন্ডিকেটের বলয় থেকে মিলছে না মুক্তি। প্রবাসে মৃত্যুর পরে লাশ দেশে আনতে ঘাটে ঘাটে হয়রানির পাশাপাশি স্বজনদের গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা। অনেক সহ লাশ মর্গে ২ মাসের বেশি থাকলে লাশের পচন শুরু হতে থাকে। একমাত্র বাংলাদেশ দূতাবাস ছাড়া সব জায়গায় যেমন, থানা পুলিশ, লাশ প্রেরণকারী এজেন্ট, হসপিটাল সহ নানা খাতে ঢালতে হয় টাকা। চাহিদামতো টাকা না দিতে পারলে মরদেহ মর্গে পড়ে থাকে মাসের পর মাস মৃতের আত্মা মুক্তির আশায়।
পুলিশ, লাশ প্রেরণকারী ফিউনারেল এজেন্ট, হসপিটাল কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে একটি অলিখিত সিন্ডিকেট তৈরি হয়ে যায়। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় সরজমিনে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে। সমস্যা দীর্ঘদিনের কিন্তু এই ভোগান্তি নিরসনে কেউ কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বিষয়টি একাধিকবার কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নজরে আনলেও তারা এসব ভোগান্তি, অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে এক প্রকার উদাসীন।

একজন প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধার সবচেয়ে দুর্ভাগ্য হলো যদি কোন কারণে প্রবাসে মারা যান। পরিবার, আত্মীয়স্বজন ছাড়া প্রবাসের মাটিতে তার মরদেহটি হস্তান্তর করতে সহযোগিতা সহ দু’ফোটা চোখের জল ফেলার মত দরদি কেউ থাকে না। তার কারণ এখানে সবাই সকাল সন্ধ্যা নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত সময় কাটান। একটি মরদেহ দেশে পাঠাতে হলে থানা পুলিশ, হসপিটাল, দূতাবাস, ফিউনারেল এজেন্ট সহ নানা ঘাটে দিন রাত দৌড়াতে হয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মো. জাহিদুর রহমান বলেন, কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহের হাসপাতাল থেকে ডেট সার্টিফিকেট, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট, কোম্পানির ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, পরিবারের এনওসি সহ যাবতীয় তথ্যদি আমাদের কাছে এনে দিলেই আমরা যাচাই করে অনুমোদন করবো। এখন প্রশ্ন হলো এসব তথ্য উপাত্ত ঘাটে ঘাটে ধরনা দিয়ে কে সংগ্রহ করে দিবে? কারণ সব প্রবাসীরা তো আত্মীয়স্বজন ও পরিবার নিয়ে আসেননি মালয়েশিয়ায়। এর সমাধান কি? কারো জানা নেই।
এরকম একটি ঘটনা ঘটলো সম্প্রতি। বগুড়ার রাফিউল ইসলাম রাফি গত ২২ শে জুন কুয়ালালামপুরস্থ একটি হসপিট লে মারা যান ব্রেইন স্ট্রোক করে। তার ভাই শরন সাংবাদিকতা করেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটি স্যাটেলাইট টিভিতে। কুয়ালালামপুর থানা থেকে পুলিশ শরনকে ফোন দিয়ে বললো, তোমার ভাইয়ের মরদেহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করার জন্য টাকা পাঠাও। তখন শরন বললো- আমার ভাই বৈধভাবে বসবাস করছে তাই যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে নিয়োগ কর্তা। কিন্তু পুলিশ বললো- সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। দ্রুত লাশ পেতে হলে এখনই টাকা পাঠাতে হবে। শরন বাধ্য হয়ে পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী প্রথমে পাঠালো ৫ হাজার রিঙ্গিত এরপর বললো আরো সাড়ে ৭শ’ রিঙ্গিত লাগবে, তারপর সেটাও দেওয়া হয়। অথচ একজন প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে ৩ হাজার ৮শ’ রিঙ্গিতই যথেষ্ট।

৫ হাজার ৭৫০ রিঙ্গিত নিয়েও গড়িমসি করতে থাকে সিন্ডিকেট প্রক্রিয়ায় দায়িত্ব পাওয়া লাশ প্রেরণকারী এজেন্ট K L Funeral services. কোন এজেন্ট লাশ পাঠাবে সেটা নির্ধারণ করবে মরদেহের স্বজন অথবা নিয়োগকর্তা। এখানে সেই সুযোগ পুলিশ দেয়নি। এই এজেন্ট এর স্বত্বাধিকারী মালয়েশিয়ান মিস্টার অপ্পু। তার সাথে দূতাবাসের দূ একজন কর্মকর্তার সখ্যতা আছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করা হলে কেউ স্বীকার করেনি। এবিষয়ে অপ্পুর কাছে ফোনে জানতে চাইলে বলেন, কোম্পানি কাগজপত্র রেডি করতে দেরি করছে তাই দেরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি হ্যালো প্ল্যানেটের নিয়োগকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মিস্টার অপ্পু আমাদের কাছে আসেনি। আসলে সব তথ্য দেয়া হবে। অপ্পুর গড়িমসি বিষয়ে জানতে চাইলে দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা মোঃ মোকসেদ বলেন, আমাদের কাছে তথ্য উপাত্ত না আসলে আমরা কি করবো? কাগজপত্র সরবরাহ করে দেন আমরা ব্যবস্থা নেব।

মিস্টার অপ্পু কোম্পানির অফিসে গিয়ে সব ডকুমেন্টস সংগ্রহ করার পর নতুন বায়না ধরলো ঈদ উপলক্ষে বিমান টিকিটের দাম বাড়তি। তাই আরো অতিরিক্ত ৮০০ রিঙ্গিত দিতে হবে নইলে লাশ পাঠানো সম্ভব নয়। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কখ ঋঁহবৎধষ ংবৎারপব এর মালিক মিস্টার অপ্পু কাছে ৫ হাজার ৭৫০ রিঙ্গিতের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমাকে পরিবার কিংবা দূতাবাস কোন দায়িত্ব বা টাকা পয়সা দেয়নি। আমাকে পুলিশ শুধু ৩৮০০ রিঙ্গিত দিয়েছে। আমার আরো টাকা লাগবে। এবিষয়ে আমি আপনার সাথে এর চেয়ে বেশি কথা বলতে পারবো না, আমাকে ফোন দিবেন না।

অবশেষে আরো অতিরিক্ত ৬০০ রিঙ্গিত দেয়ার পর গত ৩রা জুলাই রাফিউলের মরদেহ দেশে পাঠানো হয়েছে। তবে রাফিউলের পরিবার সচ্ছল বিধায় নগদ ৬৪০০ রিংগিত দেয়া সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় বর্তমান সময়ে দেড় লাখ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু অধিকাংশ প্রবাসীর পক্ষে এটা দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় চাঁদা তুলে প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠানো হয়েছে এর নজির বহু রয়েছে।
এই অতিরিক্ত খরচের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে, দূতাবাসের মিনিস্টার (শ্রম) মোঃ নাজমুস সাদাত সেলিম বলেন, কি করবেন বলুন আমি তো মাঝে মধ্যে শুনি ৮ হাজার রিংগিত বা ১০ হাজার রিংগিতও লাগছে প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে।