চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের যাত্রীদের ভিআইপি কার পার্কিং পরিণত হয়েছে অবৈধ ট্রাক টার্মিনালে। সরেজমিনে দেখা যায়, দিনরাত পার্কিং স্পট পরিপূর্ণ থাকে ভারি যানবাহন ও ট্রাকের সারিতে। রাত হলে বাড়ে শত শত ট্রাক-লরির আনাগোনা। পুরো মাঠ জুড়ে ট্রাকের বসতি। ফলে যাত্রীদের নিয়ে আসা গাড়ি রাখার স্থান হচ্ছে না কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রেলের পার্কিংয়ে।

শুধু পার্কিং নয়, জানা গেছে ডিমের আড়তদার, ফলের আড়তদার ও রিক্সা ভ্যান রাখার অবৈধ আস্তানায় পরিণত হয়েছে ভিআইপি কার পার্কিং। ভাড়া দেয়া হয়েছে গোডাউন ও রেলের জায়গা। রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যান। কারণ আছে অনেক। তবে জানা যায়, এর সাথে জড়িত একটি শক্তিশালি সিন্ডিকেট ও রেলের জিএম। তাঁদের ইশারায় প্রকাশ্যে ছোট বড় প্রতিটি ট্রাক থেকে দৈনিক ভাড়া নেওয়া হয় ১৩০-১৫০ টাকা। এভাবে দৈনিক দুই থেকে তিনশ ট্রাকের মিলন ঘটে চট্টগ্রাম রেলওয়ে পার্কিং জোনে। যা দেখেও দেখছেন না রেলের জিএম। সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, কাঁচা টাকায় রেলের অনেকের চোখ বন্ধ।

রেলওয়ে পার্কিং জোনের স্পষ্ট হিসাব, দৈনিক এ পথে আয় হচ্ছে ৩৫ হাজারেরও অধিক টাকা। মাসে ইনকাম তাঁদের ৯ লাখ ৭৫ হাজার। বছরে এক কোটি ১৭ লাখ। হদিস নেই কোথায় যাচ্ছে এ টাকা? কিংবা কার পকেট ভারি হচ্ছে। তবে এটাই জানা গেছে, সাধারণ যাত্রীদের পার্কিং জোনে নেই কোন সেবা। ভিআইপি পার্কিংও চলে গেছে এ চক্রের হাতে। তাঁরাই অবৈধ ট্রাক পার্কিং এর নামে নিয়ন্ত্রণ পেতে ব্যবসা পাকাপোক্ত করেন।

সাধারণ মানুষের অভিযোগ, এই লাখ লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারা হয় নাকি টপ টু বটম। ফলে, সিন্ডিকেট চক্রের কব্জায় চলে গেছে রেলওয়ে পার্কিং সেবাটুকু। আর এতেই ভোগান্তি বেড়েছে রেলে যাতায়াত করা সাধারণ যাত্রী ও ভিআইপিদের।

রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর এক চিফ ইন্সপেক্টর নাম অপ্রকাশে জানান, ‘পার্কিং কারা লিজ নিয়েছে আমরা জানি না। তবে রাতে দিনে পার্কিং এ ট্রাক দেখা যায় সেটা সত্য। কখনো কম কখনো আবার বেশি। সরেজমিনে দেখা গেছে, রেলের পার্কিং যেন ট্রাকের টার্মিনাল। গাড়ি রাখার জায়গাটুকুও নেই। সারিবদ্ধভাবে লরি, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, রিক্সা ও সিএনজি অটোরিকশা। এই সবই দৈনিক টাকার বিনিময়ে সেখানে রাখতে দেওয়া হয়। সামান্য জায়গা নেই যাত্রীদের গাড়ী রাখার।

আরও অভিযোগ রয়েছে, রেল কর্মকর্তাদের নিয়োজিত কিছু বহিরাগত দৈনিক ভিত্তিতে রিকশা ও সিএনজি চালকদের কাছ থেকে টাকা তুলেন। সে টাকার মূল অংশ চলে যায় কতিপয় রেল কর্মকর্তাদের পকেটে। একইভাবে রেলের গোডাউনও দেয়া হয়েছে বাইরের একটি প্রতিষ্ঠানটিকে ভাড়ায়। প্রতিদিন শত শত ডিমের খাঁচা ঢুকছে আর বেরুচ্ছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে স্টেশন থেকে। রাত হলে ডিমের পঁচা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পুরো রেল স্টেশন এলাকায়। রিকশা গ্যারেজ আর ডিমের আড়ত থেকে প্রতিবছর অবৈধ আয়ের লাখ লাখ টাকা ঢুকছে অসাধু রেল কর্তাদের পকেটে।

আরএনবি’র লোকজন জানায়, রাত এগারোটার পর কোনো ট্রেন না থাকায় আমরা স্টেশনের গেট বন্ধ রাখি। এ সুযোগে কিছু রিকশাওয়ালা হয়তো তাদের রিকশা এখানে রাখেন। গোডাউন ভাড়ার বিষয়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনিও মুখ খুলতে নারাজ।

রেলের এসব কর্মকান্ডের সাথে শাহ আলম নামে এক ব্যক্তি জড়িত বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। জানা যায় তিনি রেলের কেউ নয়। কিন্তু রেলের সব কিছুই তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। রেলের যত জায়গা, দোকান, রেলের ক্যান্টিন ওর হাতেই জিম্মি। এসব কথা শুনে ওই ব্যক্তির নম্বর সংগ্রহ করে একাধিক কল করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে এসব অব্যবস্থাপনা এবং দায়িত্বে অবহেলা ও অবৈধ ট্রাক পার্কিং এর বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ‘রেলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পার্কিং ইজারা দেওয়া হয়েছিল। তার মেয়াদ শেষ হয়েছে। নতুন করে আবারো পার্কিং ইজারা দেওয়া হবে। টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু কোন লরি, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান রাখার জন্য রেলওয়ে পার্কিং ইজারা দেওয়া হয়নি। কারণ এসব পার্কিং এর জায়গায় যাত্রীদের গাড়ি রাখার জন্য। যদি কোন কারণে কেউ ট্রাক রাখেন তাহলে সেটা অবৈধ। এসব অবৈধ কাজে যারাই জড়িত থাকুক। শিগগিরই অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, দোকানপাট দেখে দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার করেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম। তাঁরা হলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শামস মো. তুষার ও স্টেশন ব্যবস্থাপক রতন কুমার চৌধুরী।

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি