আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
পৌনে তিন শত বছর আগে দক্ষিণ এশিয়া বা তথকালিন ভারত বর্ষ বলতে যেটা বোঝায় তাতে ইতিহাসের পাতায় ইতিহাসিক একটি চরিত্রের নাম গোপাল ভাঁড়। ভারত সহ বাংলাদেশেও গোপাল ভাঁড়ের কাটুর্ন প্রচারিত হচ্ছে নিয়মিত ভাবেই।
বর্তমান টিভি মিডিয়ার কল্যাণে গোপল ভাঁড় অতি জনপ্রিয় একটি নাম। ১৭৫৭ সালের আগে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সরিয়ে ভারত বর্ষে ইংরেজদের দখলের ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে সে সময় যে সব রাজারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও অন্যতম। গোপাল ভাঁড় ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ সভায় অন্যতম একজন গ্রহণযোগ সদস্য। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপাল ভাঁড়ের পরামর্শ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই গ্রহণ করতে। কিন্ত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নবাবের বিপক্ষে গিযে ইংরেজদের পক্ষে যাবার ঘটনাটি মেনে নিতে পারেননি। যে কারণে ইতিহাসের পাতায় গোপাল ভাঁড় শেষ সময়ে (পলাশীর যুদ্ধ) রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এর রাজ্য ছেড়ে কোথায় গিয়েছেন এবং তাঁর কি হয়েছিল তা আজও অজানা।
ভারত বর্ষে ইংরেজদের ২০০ শত বছর দখলের রাজ্যত্ব নিয়ে ভারতীয়দের মাঝে আজও চরম ঘৃণা স্পষ্ট। সেই ভারতের একজন রাজা ইংরেজদের পক্ষে কাজ করেছে, সেটা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতেই কি ভারতীয় মিডিয়াি গোপাল ভাঁড়ের চরিত্রটা অস্বীকার করছে। ভারতীয় মিডিয়া ২০২২ সালে এসে ঘোষণা দিয়েছে, গোপাল ভাঁড় না-কি কোন ঐতিহাসিক চরিত্রই না!
বিস্ময় কর একটি অধ্যায় শুরু হয়েছে ভারতীয় মিডিয়াতে। ভারতের কলকাতার অনলাইন মিডিয়ার ৩য় স্থানে থাকা বর্তমান পত্রিকার অনলাইনে গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে এ প্রসঙ্গে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছ। যার লিঙ্কটি হলো- https://bartamanpatrika.com/home?cid=32&id=362691
বর্তমান পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত লেখাটি হুবহু পাঠাকদের জন্য তুলে ধরা হলো —
‘গোপাল ভাঁড় সম্ভবত কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। লৌকিক মিথ আর ওরাল হিস্ট্রি থেকে উঠে আসা উত্তর ভারতীয় বিদূষক বীরবল, দক্ষিণ ভারতীয় তেনালি রাম জাতীয় চরিত্রগুলির এটি একটি বঙ্গজ সংস্করণ। যদিও দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায় নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় মুক্তারাম মুখোপাধ্যায়, গোপাল ভাঁড়, হাস্যার্ণব নামক তিন বয়স্য পরিহাসিকের কথা লিখেছিলেন, কিন্তু নদীয়া রাজবাড়ির দলিল, দস্তাবেজ, কাছারির হিসাবপত্র বা নদীয়া কালেক্টরেটের কোনও তায়দাদে এমন কোনও নামের উল্লেখ নেই। ঐতিহাসিকভাবে যদি তেমন কোনও চরিত্র থাকত, তবে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’-এর কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার বর্ণনায় সেই নামের নিশ্চয়ই উল্লেখ করতেন।
এক্ষেত্রে বরং সুকুমার সেনের কথাটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। সুকুমার সেনের মতে, গোপাল ভাঁড় কলকাতার উনিশ শতকের বটতলা সাহিত্যের একটি নির্মাণ। বাংলার নিজস্ব এই ভাঁড়ের কালক্রমে ঘাড়ে চেপে গেছে সমকালীন নদীয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের বিভিন্ন হাস্যরসাত্মক কিস্সা কাহিনি, চুটকি ইত্যাদি। যেমন কৃষ্ণচন্দ্রের নবরত্ন সভার অন্যতম এক চরিত্র মুক্তারাম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজার কথোপকথনের আদলে লিখিত ক্ষীরের হ্রদ, বিষ্ঠার হ্রদ গল্পটি পরবর্তীকালে গোপাল ভাঁড়ের গল্প হিসাবে খ্যাত হয়ে গিয়েছে। এইরকম অজস্র স্থানীয় দেশি বিদেশি হাসির গল্প প্রক্ষিপ্ত হয়ে জুড়ে গিয়েছে গোপাল ভাঁড়ের সঙ্গে। আর তা বটতলা প্রকাশনার দৌলতে লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। তবে ছাপার অক্ষরে এই চরিত্রটির প্রথম দেখা মেলে ‘কৌতুক বিলাস’ নামক একটি গ্রন্থে, যেটি দ্বিজ শ্যামাচরণ বা শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায় নামক একজন লেখকের লেখায়।
নবদ্বীপাধিপতি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপালকে নিয়ে মঙ্গলকাব্যের ধাঁচে সেই কৌতুক-নাট্য ছাপা হয় ১২৫৮ সনে, সম্বাদ ভৃঙ্গদূত যন্ত্রের মাধ্যমে। মতান্তরে সালটি শকাব্দ ১৭৬৫, ৭ বৈশাখ। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দ। শিলচর নর্মাল স্কুলের তুলোট কাগজের পুঁথিটির লিখনের যে সময়কাল অনুমান করা যায় তা তিনশো বছরের বেশি নয়। ‘কৌতুক বিলাস’ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র-এর স্তুতিমূলক রচনা। এর আখ্যানবৃত্তে নদীয়ারাজকে দেখানো হয়েছে এক স্বর্গভ্রষ্ট দেবতা হিসাবে এবং রাজার এই মর্তলীলা বিলাসে বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার মতো তাঁর যে পঞ্চরত্ন সভার কথা বলা হয়েছে সেই বর্ণনার পরেই শুরু হয়েছে গোপাল ভাঁড়ের আখ্যান যা সম্পূর্ণই কল্পনাপ্রসূত বলাই বাহুল্য।’
সূত্র : বর্তমান পত্রিকার অনলাইন (কলকাতা)