নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহত মাইশা মমতাজ মীমের গাজীপুরের বাড়ীতে শনিবারেও কান্নার রোল থামেনি। নিহতের আত্মীয় স্বজনসহ সহপাঠি ও বন্ধু বান্ধব এবং প্রতিবেশীরা এদিন ভীড় জমিয়েছেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক এলাকার গ্রামের বাড়িতে। বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন নিহত মাইশার বাবা-মাসহ স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে পুরো পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। সবার চোখেই ছিল জল। বিষ্ময় চোখে সকলেই আফসোস করছেন এবং মাইশার শৈশব কৈশোরের স্মৃতি নিয়ে নানা ধরণের কথা বলছেন।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার উড়াল সড়কে দুর্ঘটনায় নিহত হন মাইশা। তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছুটির দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা শিক্ষা প্রতিযোগিতার একটি অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্ব পালন করতে তিনি স্কুটি নিয়ে উত্তরার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। স্কুটি চালিয়ে যাবার সময় খিলক্ষেত থানা এলাকায় উড়াল সড়ক দিয়ে ৩০০ ফুট সড়কে নামার মুখে দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। নিজের স্কুটির পাশে পড়ে থাকা মাইশার রক্তাক্ত নিথর দেহ উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান পথচারীরা। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে গাজীপুরের মৌচাকে গ্রামের বাড়িতে তাকে দাফন করা হয়।

শনিবার মাইশার বাড়িতে স্বজন, প্রতিবেশী, সহপাঠীরা সকাল থেকেই ভীড় জমিয়েছেন। এদিনও বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন নিহত মাইশার বাবা নূর মোহাম্মদ মামুন ও মা আসমা বেগমসহ স্বজনরা। বিলাপ করে কান্না করছিলেন তারা। মাঝে মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন নিহতের বাবা-মা। স্বজনরা শান্তনা দিয়েও ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তাদের আহাজারি দেখে উপস্থিতরা চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না।

মাইশার বাবা নূর মোহাম্মদ বিলাপ করছেন, “মাগো তোমাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। তুমি এরকমভাবে চলে যাবে কল্পনাতেও ছিল না। তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন আমি বাস্তবায়ন করতে চাই। তুমি চলে এসো মা।”

মাইশার স্বজনরা জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানাধীন মৌচাক এলাকার আইডিয়াল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নূর মোহাম্মদ মামুনের দুই মেয়ের মধ্যে মাইশা বড়। বাবার গড়া ওই কলেজ থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন মাইশা। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তার ছোট বোন রৌদোসী মমতাজ মৌ উত্তরা রাজউক কলেজের এইচএসসি’র শিক্ষার্থী। সন্তানদের লেখাপড়ার কারণে নূর মোহাম্মদ মামুন স্বপরিবারে উত্তরায় বসবাস করেন। রাজধানীর উত্তরা ৬নং সেক্টরের ১০ রোডের ৯ নম্বর বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন মীম।

মাইশার সহগপাঠী বর্তমানে গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রাজিউন নবী বলেন, খুব ভাল মেয়ে ছিল মাইশা। মাধ্যমিকে পড়ার সময় তার আচরণে বুঝতে পারিনি এটি তার বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুল। নিরহংকার একটি মেয়ে ছিল সে।

মাইশার স্কুল শিক্ষক আবুল কালাম বলেন, মাইশা বিনয় এবং মেধাবী ছিল। তার ছোট বোনও ভাল ছাত্রী। সমানতালে পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল।

মৌচাক আইডিয়াল স্কুলের কনফেকশনারী স্টোরের মালিক তাজুল ইসলাম বলেন, ভদ্র ও বিনয়ী বলতে যা বোঝায় মেয়েটি সেরকম ছিল। তার জন্য আমাদেরও আফসোস হয়। এমন একটি মেয়ে এভাবে চলে গেল ভাবতেই কষ্ট হয়। অঅমরা এমন মৃত্যু চাই না। আমিও একজন বাবা হিসেবে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।

প্রতিবেশী অভিভাবক বায়েজীদ হোসেন বলেন, মাইশা মেয়েটা আমাদের চোখের সামনে ছুটোছুটি-দৌড়ঝাঁপ করেছে, বড় হয়েছে। এমনভাবে সন্তান মারা গেলে কোনো বাবা-মা সাহস করবে না তার সন্তানকে চোখের আড়ালে দিতে। আমাদের দেশে কবে সেই দিন হবে যেদিন সন্তানকে শিক্ষার জন্য বাড়ির বাইরে বের করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকতে হবে না?

মাইশার মৃত্যুর বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রতিবেশী নাজমুল সৈকত বলেন, মাইশা মূলত: স্কুটি চালিয়ে উড়াল সড়কের এক পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় পেছন থেকে একটি কাভার্ড ভ্যান ওই স্কুটির পেছনে ধাক্কা দেয়। এতে মাইশা কাভার্ড ভ্যানের চাকার নিচে চাপা পড়ে। বিলম্ব না করে কাভার্ড ভ্যানটি পাালিয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে তার মরদেহ উদ্ধার।