রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় পানির জন্য বিষ পান করে মারা যাওয়া কৃষক অভিনাথ মারান্ডির (৩৬) পর মারা গেলেন তাঁর চাচাতো ভাই রবি মারান্ডিও (২৭)। এই দুই ভাই গত বুধবার একই দিন বিষপান করেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ শুক্রবার রাত ৮টার দিকে রবি মারান্ডি মারা যান। স্থানীয়রা জানান, অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডি দুজনেই বোরো ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু ১২ দিন ধরে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপে ঘুরলেও তাঁরা সেচের পানি পাচ্ছিলেন না। এই ক্ষোভে গত বুধবার সন্ধ্যার আগে গভীর নলকূপের সামনেই দুজনে বিষ পান করেন। এতে গ্রামেই অভিনাথের মৃত্যু হয়। আর রবিকে ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালে। এ দুই কৃষকের বাড়ি গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউনিয়নের নিমঘুটু গ্রামে।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘বিষক্রিয়ার কারণে রবি মারান্ডি ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। রাত ৮টায় তিনি মারা গেছেন।’ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বিকেলে রবি মারান্ডি বিষপানের কথা স্বীকার করেছিলেন। কেন বিষ খেয়েছেন—জানতে চাইলে শুধু বলেছিলেন, ‘দুঃখ লেগেছিল।’ কী দুঃখ তা জানতে চাইলে রবি আর কোনো কথা বলতে পারেননি।
পানির জন্য দুই কৃষকের বিষপানের জন্য গভীর নলকূপ অপারেটর এবং ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেনকে দায়ী করছেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কৃষকেরা। তবে এ বিষয়টিকে পুলিশ, প্রশাসন কিংবা বিএমডিএ গুরুত্ব দেয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার পুলিশ অভিনাথের বাড়ি থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করলেও থানায় করা হয় অপমৃত্যুর (ইউডি) মামলা। এ মামলার বাদী করা হয় অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রমকে। মামলাটি করতে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরেই পুলিশ রোজিনার বাড়িতে একটি সাদা কাগজে তাঁর স্বাক্ষর নিয়েছিল। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এই নারী আইনকানুন, মামলা-মোকদ্দমা বোঝেন না। তবে আজ শুক্রবার রোজিনা জানতে পারেন, তাঁর স্বামীর মৃত্যুর ঘটনায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে না। এর প্রতিবাদে বিকেলে তিনি গোদাগাড়ী থানায় যান। পুলিশ দীর্ঘ সময় তাঁকে বসিয়ে রাখে।
পরে থানায় যান আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি রোজিনা হেমব্রমের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। এরপর আজ শুক্রবার রাতে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা নেয় পুলিশ।
এদিকে থানায় যাওয়ার আগে রাজশাহী সদর আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা গোদাগাড়ীর নিমঘুটু গ্রামে অভিনাথ মারান্ডির বাড়ি যান এবং তাঁর মা সোহাগী সরেনকে সান্ত্বনা দেন। পরে গোদাগাড়ী থানার সামনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষজন আবেগী। ১২ দিন ঘুরেও যখন ফসল রক্ষার জন্য অভিনাথ পানি পাননি, তখন আবেগের বশে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতি বৈষম্য করা হয়। এই নিপীড়ন গোটা গোদাগাড়ী ও তানোর এলাকায়। এ ব্যাপারে সরকার এবং মানবাধিকার কমিশনসহ উচ্চপর্যায়ের যেন তদন্ত হয়।
আজ শুক্রবার সকালে নিমঘুটুতে গিয়ে সাখাওয়াতকে তাঁর গভীর নলকূপের সামনেই দেখা গেছে। অনুসারী কিছু কৃষককে নিয়ে তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। কেউ গেলে অনুসারী কৃষকেরা সাখাওয়াতের পক্ষে সাফাই গাইছিলেন। তবে সন্ধ্যা থেকে সাখাওয়াতকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মামলা করতে গ্রামের এক-দেড় শ মানুষ থানায় এসেছে। তাহলে আসামি থাকে? সে গা-ঢাকা দিয়েছে। তাও তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’ ওসি জানান, রবির মৃত্যুর খবর তিনিও শুনেছেন।