অনাকাক্সিক্ষত সড়ক দুর্ঘটনা জনমনে আতঙ্কের সঞ্চার করেছে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু রোধকরা যাচ্ছে না। দেশের সর্বত্র এমন দুর্ঘটনা একটি অহরহ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতা উল্টালেই বহু অমূল্য জীবনের প্রাণনাশের ঘটনা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। সুস্থ সবল মানুষ পঙ্গু হচ্ছে মুহূর্তে। কেউ পা হারাচ্ছে, কেউ হাত হারাচ্ছে, কেউ মাথা ফাটাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি হওয়াও সারা জীবনের কান্না হিসাবে একটি পরিবারের কাছে বিবেচিত হয়। এমন মৃত্যুর মিছিল, দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলছে সমানে। প্রতি বছর সড়কে মৃত্যুর মিছিলে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ, ধূলিস্যাৎ হচ্ছে হাজারো স্বপ্ন, খালি হচ্ছে মায়ের কোল, স্ত্রী হারাচ্ছেন স্বামী, স্বামী হারাচ্ছেন স্ত্রী। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু সাধারণ মানুষই নয় বরং সাংবাদিক, সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্য, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাসহ বহু কবি সাহিত্যিকও মারা গেছেন বা গুরুতর আহত হচ্ছেন। সড়ক দুর্ঘটনা যেন আজ আমাদের নিরাপত্তার প্রধান হুমকি। সংবাদপত্রে প্রথমে যে খবরটি চোখের সামনে চলে আসে তা হলো সড়কে দুর্ঘটনা, যার চিত্র বা পরিসংখ্যান দেখলে শিউরে উঠি। সেই সংবাদপত্রে থাকে লাশের ছবি। প্রকাশিত ছবি দেখলে মনে হয় সড়কে লাশের মিছিল হচ্ছে। প্রশ্ন হলো সড়কে লাশের মিছিল বন্ধ হবে কবে? আর কত প্রাণ বিনাশ হলে, আর কত রক্ত ঝরলে, লাশের মিছিল আর কত বড় হলে থামবে সড়ক দুর্ঘটনা বা হ্রাস পাবে? এমন কেউ কি নেই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার? বিষয়টি মহামারি আকার ধারণ করেছে। প্রশ্ন হল সড়কে এসব অনিয়ম থাকবে আর কতকাল? সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত স্বজনদের আহাজারি আর কতকাল? সড়কে লাশের মিছিল বন্ধ হবে কবে? এটা শুধু শুধু সড়ক দুর্ঘটনা বলে উড়িয়ে দেবার নয়।
আজকাল চাকুরীজীবী, ছাত্র-ছাত্রী এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিগণ নির্ধারিত সময়ে বাসায় না ফিরলে বা গন্তব্যস্থলে না পৌঁছলে সর্বপ্রথমে যে কথাটি মনে দোলা দেয় সে দুর্ঘটনায় পড়েনি তো? তাই ব্যতীব্যস্ত হয়ে খোঁজ নিতে হয় হাসপাতালে বা থানায়। সড়ক দুর্ঘটনা বিভিন্নভাবে সংঘটিত হতে পারে। মানুষের নির্বিকার চলাফেরা অসাবধানে রাস্তা পারাপার, ফুটপাত ছেড়ে রাস্তার মাঝ দিয়ে চলা, ট্রাফিকের সাহায্য না নিয়ে রাস্তা পারাপার। সিগনাল না মেনে চলা। চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালনা। এগুলোর মধ্যে চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালনাই দুর্ঘটনার জন্য বেশি দায়ী। এছাড়া গাড়ির ব্রেক থাকেনা। আবার থাকলেও চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে গাড়ি ফেরিঘাটে অতল গহ্বরে, রাস্তার পার্শ্বের নদী, খাল বা ডোবায় নিপতিত হয়। দক্ষ চালকের অভাবে, আবার কখনও কখনও গাড়ির হেলপার গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়।
দুর্ঘটনার কারণ একটা নয়, একাধিক। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ বাস, মিনিবাস এবং বিশেষভাবে ট্রাক চালকরাই এর জন্য দায়ী। ১৯৭২ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের যখন জনশক্তি রপ্তানি চুক্তি হয় তখন দেশের বয়স্ক অভিজ্ঞ চালকদের অভাব দেখা দেয়। তখন সে সব কমবয়সী যুবকেরা হেলপার ও সাহায্যকারী হিসেবে বাস, মিনিবাস ও ট্রাকে কাজ করতো, তারা অসদুপায়ে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স বা স্বীকৃতি পায়। এরা দক্ষ চালক নয়। ফলে গাড়ি চালানোর সময় বেপরোয়া হয়। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। দুর্ঘটনা ঘটিয়ে শত শত যাত্রী ও পথচারির জীবন মরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ট্রাক চালকদের নাম হয়ে গেছে ঘাতক চালক। এরা রাস্তাতে বিমানের গতিতে গাড়ি চালাতে চায়। আবার অনেক সময় একটি অনাকাঙিক্ষত দুর্ঘটনা পর পর আরো কয়েকটি দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় যাত্রী উঠানো নামানোর জন্যও দুর্ঘটনা ঘটে। সিগন্যাল বাতি না মানা বা রাস্তার হলুদ লাইন অবাধে ক্রস করা বা স্পীড না মানা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। পথ অবরোধ, পথসভা, আড্ডা ইত্যাদি কারণেও যানজট হয়। যানবাহন নিয়ন্ত্রণ তখন আরও কঠিন হয়ে পড়ে। হকারদের ফুটপাত দখল পথচারীদের পথে নামতে বাধ্য করে এবং দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া রয়েছে গাড়ির যান্ত্রিক গোলযোগ। গাড়ির ব্রেক বা গতিরোধক যন্ত্র ত্রুটিযুক্ত। চালকরা এ সকল গাড়ির গতি সহসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কখনও ইঞ্জিন থাকে ত্রুটিযুক্ত। এসব কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলো যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখব সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ গাড়িতে অতিরিক্ত গতি বা বেপরোয়া গাড়ি চালানো। শুধু আইন প্রণয়ন করে শাস্তির ব্যবস্থা করেই সর্বনাশা জীবননাশ হতে অব্যাহতি পাওয়া যাবে না। আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং জনগণ ও সরকারকে সমবেতভাবে সচেষ্ট হতে হবে। দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের দেশে যেসব আইন রয়েছে তা যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব। জরাজীর্ণ এবং সংকীর্ণ রাস্তাগুলো সংস্কারের মাধ্যমে প্রশস্তকরণ সহ ফুটপাত নির্মাণ এবং নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ করে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব। গাড়ি চালকদের সতর্ক ও দক্ষ হতে হবে। অদক্ষ ব্যক্তিদের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল এবং তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে যাবে। দুর্ঘটনা রোধে দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে আরও স্ব”ছ ও শক্তিশালী করতে হবে। রাস্তায় পুরনো আর নিষিদ্ধ গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিকদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সময় বাঁচাতে গিয়ে সাধারণ লোকজন যেন যত্রতত্র যাত্রা পারাপার না করে এবং ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করে সেদিকে ট্রাফিকের দৃষ্টি বাড়াতে হবে। গাড়ি চালকরা যেন ড্রাইভ করার সময় কোনো নেশা বা মোবাইল ফোনে কথা না বলে সে ব্যাপারে কঠোর আইন তৈরি করা। বি.আর.টি.এ-এর উদ্যোগে চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি মানবিকতাবোধ ও সামাজিক দায়িত্ববোধে চালকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে জনসচেতনতা বিষয়ক বিজ্ঞাপন, নাটিকা, সংলাপ প্রভৃতির প্রচারণা বৃদ্ধি করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য জনগণকে সরকারের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হতে হবে। সরকার ও জনগণ উভয়ের সচেতনতার মাধ্যমেই শুধু এই সামাজিক নিষ্ঠুর অপরাধের প্রতিকার সম্ভব। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারকে অবশ্যই সামনের দিকে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা সরকারের মহান দায়িত্ব। আর প্রতিশ্রুতি নয়, আশার বাণী নয়- সড়ক দুর্ঘটনা সামলানো হোক, মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হোক- এই মুহূর্তে এটাই হোক বাস্তবায়নের প্রধান কর্মসূচি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক