বাংলাদেশের এখন প্রধান এবং এক নম্বর সমস্যা সড়কে হত্যা, সড়কে হত্যা মহামারীর রূপ নিয়েছে, প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে “অমুক স্থানে অমুক সড়কে মৃত্যু” আর বেশির ভাগ সড়কে মৃত্যুর খবর মিডিয়াতে আসেই না। আবার অনেক পত্রিকার হেডলাইন হয় “সড়কে হত্যার মিছিল” “সড়ক যেন মৃত্যুপুরী”, “থামছে না সড়কে হত্যা”,”২৮ লক্ষ লাইসেন্সহীন চালক”, প্রায় ৯ লাখ ফিটনেসহীন গাড়ি” – এইসব কোনো সংবাদই কর্তৃপক্ষের বা নীতি নির্ধারকদের চোখে পড়ে না। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন মিডিয়ায় বলেন, পথচারীরা সচেতন হলেই সড়কে মৃত্যু কমবে। তারা আদৌ জানেনই না সড়কে মৃত্যুর আসল কারণ। তাই দায়সারা বক্তব্য দেন আর যে বা যারা সামাজিক আন্দোলন করেন তারাও আজো কোনো নীতিমালা দিতে পারেননি বা তাদের দেয়া প্রস্তাব কখনো গ্রহণ হয় না, আমলেও নেয়া হয় না। এর ফলে প্রতিনিয়ত সড়কে মৃত্যু বাড়ছেই।
এক জরিপে বলা হয়েছে সড়কে মৃত্যুর হার ১৮% হারে বাড়ছে । সড়কে মৃত্যুর শিকারদের ৩৯ শতাংশই শিক্ষার্থী। এর প্রধান ও অন্যতম কারণ বিচারহীনতা! বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৪ জন নিহত হয়৷ আর এই সংখ্যা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যার মধ্যে সর্বোচ্চ৷ সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)-এর জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে৷ বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত সংঘটিত একটি আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ। ঢাকায় ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের রেষারেষিতে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। পরবর্তীতে ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভা একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করে, যে আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়; যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বেপরোয়া চালনায় মৃত্যুদন্ড দাবি করেছিল।
৬ আগস্ট, মন্ত্রিসভায় নতুন ট্রাফিক আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়, যেটাতে মোটরযান দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ হত্যা করলে মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে হত্যা করলে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ আইনটি সংসদে পাশ হয়। ওই বছর ৮ অক্টোবর এর গেজেট জারি করা হয়। ৭-৯ আগস্ট ও ২৮-৩০ আগস্ট পরিবহনশ্রমিকরা দেশের ১৭টি জেলায় নতুন আইনের শাস্তি কমানো ও অন্যান্য সংশোধনসহ ৮ দফা দাবিতে ধর্মঘট করে।তারা গণপরিবহনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, মোটরসাইকেলসহ সবধরনের যানবাহন আটকে দেয়, অনেক গাড়ির চালক ও যাত্রীদেরকে হেনস্থা ও মারধোর করে এবং মুখে ও পোশাকে পোড়া মবিল মাখিয়ে দেয়।তারা হাসপাতালগামী অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় মৌলভিবাজার ও সুনামগঞ্জে দুটি নবজাতক শিশু মারা যায়,২২ অক্টোবর ২০১৯ বুধবার আইনটি কার্যকরের তারিখ ঘোষণা করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন হয়েছে। আইনটি পাসের প্রায় এক বছর দুই মাস পর এ ঘোষণা এল।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ধারা ১ এর উপধারা (২) এ দেওয়া ক্ষমতাবলে সরকার ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে আইন কার্যকর হওয়ার তারিখ নির্ধারণ করল।’ এর ফলে আইনটি সংশোধন বা পরিবর্তন ছাড়াই কার্যকর হতে যাচ্ছে। নিরাপদ সড়ক চাই এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন আইনে সাজা বা অনেক বিষয় আমাদের চাওয়া অনুযায়ী হয়নি। তারপরও যা আছে তা অতীতের চেয়ে অনেক ভালো।’ তিনি বলেন, অতীতে মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলো আন্দোলন করে আইনকে দুর্বল করে দিয়েছে এই আন্দোলনের পরেই শিক্ষার্থীদের প্রাণ কাড়া শুরু হয়, ঢাকার শুধু সিটি এলাকায়ই প্রাণ হারায় ফাইযা, আদনান তাসিন, আবরার, লাবণ্য, তানজিলা, আরিফ, সাব্বির, আবিরসহ অনেকেই, আর সিলেটের ওয়াসিম, গাজীপুরে সালাহুদ্দিন, সাভারের শিল্পিকে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হয়।
সেন্ট জোসেফ-এর একাদশ শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থী আদনান তাসিন ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ কলেজ থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিমানবন্দর সড়কে যেখানে আকাশ পাতাল কাঁপানো শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া আন্দোলন হয়, ঠিক তার কয়েক গজ উত্তরে জোয়ার সাহারা বাসস্ট্যান্ড (আদনান চত্বর) সেখানে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হবার সময়ে তাকে শিক্ষার্থীর পোশাকে দেখে দ্রুতগামী বাসচালক ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে বাসের চাকায় পিষ্ট করে নির্মমভাবে খুন করে ২ নভেম্বর ২০১৯ সকালে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে বিআরটিএ’র (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১ নভেম্বর থেকে এই আইন কার্যকর করা হয়েছে। নতুন সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে দুর্ঘটনা কমে যাওয়াসহ সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের জন্য এখন সারাদেশে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আগামী সাতদিন মানে ৯ নভেম্বর ২০১৯ এই প্রচারণা চলবে। এসময় কোনও পরিবহনের বিরুদ্ধে নতুন আইনে মামলা দায়ের না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এ আইন বাস্তবায়নে বিভিন্ন মহল আরও সময় চাচ্ছিল, তাদেরকে সময় দেওয়া হলো না কেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, এ আইন আরও দেরিতে বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চাপ এসেছিল। সেই চাপ বিবেচনা করেই এই ১৫-১৬ দিন বাড়তি সময় দেওয়া হয়েছে।
১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে নিরাপদ সড়ক আইন কার্যকরের কথা থাকলেও তা করা যায়নি৷ শুরুর দিনেই নানা জটিলতার মুখে আইন কার্যকর করতে এক সপ্তাহ সময় নেয়া হয়৷ এর উদ্দেশ্য ছিল আইনটি সম্পর্কে পরিবহণ মালিক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ও ট্রাফিক পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগকে সচেতন করা৷ শেষমেশ আরো সময় বাড়িয়ে ১৮ নভেম্বর ২০১৯ (সোমবার) থেকে এই আইনটি কার্যকর করার কথা ছিল-
সড়ক পরিবহন আইন ১৮ নভেম্বর ২০১৯ থেকে কার্যকরের কথার পর থেকেই বিভিন্ন ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়ে যশোর থেকে দেশের ১৮টি রুটে ধর্মঘট শুরু করে পরিবহন শ্রমিকরা – গণপরিবহনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, মোটরসাইকেলসহ সবধরনের যানবাহন আটকে দেয়, অনেক গাড়ির চালক ও যাত্রীদেরকে হেনস্থা ও মারধোর করে এবং মুখে ও পোশাকে পোড়া মবিল মাখিয়ে দেয়।তারা হাসপাতালগামী অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায়,আর আইন রক্ষা বাহিনী প্রশাসন নীরবে গুটি কয়েক লোকের সড়কে নৈরাজ্য দেখছিলেন, আর কিছু উগ্রবাদী উৎশৃঙ্খল কর্মীরা ২১শে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সমাজসেবক জনপ্রিয় চিত্রনায়ক, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিকে প্রকাশ্য রাজপথে অবমাননা করে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নতুন সড়ক আইনের ৯টি ধারা পরিবর্তন চেয়েছে। এগুলো হচ্ছে: ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৮৪, ৮৬, ৯০, ৯৮ ও ১০৫। এর মধ্যে ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারা সবচেয়ে কঠোর এবং এর অপরাধে মামলা অজামিনযোগ্য। এর বাইরে চালকের লাইসেন্স-সংক্রান্ত ৬৬ ধারা এখনই প্রয়োগ না করার দাবি করেছে।মালিক-শ্রমিকদের, সেগুলো বিবেচনায় নিয়েছে সরকার। যেসব ধারার কারণে মালিক-শ্রমিকেরা বড় ধরনের আর্থিক জরিমানায় পড়তে পারেন।সেগুলোর প্রয়োগ এ বছরের জুন পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক-শ্রমিকেরা সারা দেশে পণ্য পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
দেশে মহামারী করোনায় লকডাউন চলছে, সড়কে কোন গণপরিবহন নেই – শুধু জরুরি পণ্যবহনে কিছু পরিবহন চলছে, তারপরও মহামারী করোনায় মৃত্যুর চেয়ে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ, করোনাকালীন মার্চ-এপ্রিলে ২০২০ করোনায় ১৬৮, সড়কে ৫৬৫ মৃত্যু। সবশেষ ,২০২১ জুন মাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় লকডাউন ও বিধিনিষেধ চললেও সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনা উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। তারা জানিয়েছে, জুনে ৩৯৮ জন মারা গেছেন, দুর্ঘটনায় নিহত ৮২ শতাংশের বেশি কর্মক্ষম মানুষ। ২-৩% সংবাদ মিডিয়ায় আসে আর বাকি ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়, যেমন মেধাবী শিক্ষার্থী আদনান তাসিন দুপুর ১টায় বিমান সড়কে জেব্রা ক্রসিনের উপর হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও কোন মিডিয়ায় তার হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচার হয়নি, সড়কে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল কিন্তু একজন হত্যাকারী ঘাতককেও ধরা হয়না, কোন চাপে ধরা হলেও বিচার হয় না – আর সাজারতো নজির নেই। করনার চেয়েও ভয়াভহ সড়কে অবাধ হত্যাকাণ্ড – প্রতিটি ঘটনার একই কথা চালক ও তাঁর সহকারী পলাতক” – এটা কি ব্যর্থতা নাকি স্বার্থের আফিম , নাকি উপরের নির্দেশ ” ঘাতক ধরা নিষেধ ”
সড়কে মৃত্যুর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সরকারের সকল উন্নয়ন ঢাকা পড়ে যাবে সড়কে মৃত্যুর কাছে।বিচারহিনতা অপরাধ প্রবণতাকে উতসাহিত করে। দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে সকল গণপরিবহন বন্ধ থাকবে ,এখন শুধু জরুরী পণ্যবাহী কিছু যানবাহন চলাচল করছে তথাপিও সড়কে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০-১৬ জন প্রান হারাচ্ছেন, সড়কে সন্তান স্বজনহারা পরিবার ফোরাম এর আহ্বায়ক আহসান উল্লাহ টুটুল‘সড়ক পরিবহণ আইন’ আগামী ‘সড়ক পরিবহণ আইন’ আগামী ১৫ জুলাই ২০২১ থেকে কার্যকর করার দাবি – জানাচ্ছি…।। আর না হয় সড়কের প্রানহানী ভয়াবহ রুপ নিবে।
‘সড়কে সন্তান স্বজনহারা পরিবার ফোরাম’ এর দাবিসমুহ (১) সড়ক হত্যা বন্ধ (২) হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও সাজা (৩) সড়ক নিরাপত্তা আইন কার্যকর (৪) সড়ক নিরাপত্তা আইনের ১০৫ ধারা সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ড / যাবৎজিবন করতে হবে এবং (৫)সড়ক নিরাপত্তা আইনে পরিবহণ মালিক
দেরকেও সাজার বিধান রাখতে হবে (হত্যাকারীকে পাওয়া না গেলে মালিককেই সাজার আওতায় আনতে হবে) (৬) সড়কে সন্তান স্বজনহারা পরিবারকে ক্ষতিপুরুন সহ তাদের পরিবারের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে (৭) খুনী যানবাহনটি /হত্যায় ব্যবহৃত যানবাহনটি মুল আসামী গ্রেফতার না করা পর্যন্ত থানার জিম্মায় রাখতে হবে।
আহসান উল্লাহ টুটুল
‘সড়কে সন্তান স্বজনহারা পরিবার ফোরাম’