নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে সেই আগুন তৎক্ষণাৎ নিভিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনা করেছিলেন রিতা বেগম (৩৫)। তাঁর পরিকল্পনার সঙ্গে স্বামী ও সন্তানও জড়িত ছিলেন। নিজের শরীরে লাগানো আগুন নিভাতে ব্যর্থ হওয়ায় সেই আগুনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান গৃহবধূ রিতা বেগম। গৃহবধূর গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা মামলার ঘটনায় তদন্তে নেমে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসার দাবি করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (২৭ মে) দুপুরে নওগাঁর পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান মিয়া তাঁর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে আব্দুল মান্নান মিয়া বলেন, গত ৩০ এপ্রিল রাতে নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের চকচাপাই গ্রামের মোসলেম প্রামানিকের স্ত্রী রিতা বেগম অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুত্বর আহত হন। পর দিন বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে তিনি মারা যান। এই ঘটনায় নিহত রিতা বেগমের মা রোকেয়া বেওয়া বাদী হয়ে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে রিতা বেগমে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে প্রতিপক্ষ আলামিন প্রামানিক, সানোয়ার প্রামানিক ও জলিল প্রামানিকের বিরুদ্ধে নওগাঁ সদর থানায় মামলা করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতে পারেন গত ২৪ এপ্রিল একটি অজ্ঞাতনামা একটি নাম্বার থেকে রিতা বেগমের প্রতিবেশী ময়েন উদ্দিনের মোবাইলে একটি ক্ষুদে বার্তা (এসএমএস) আসে। ওই ক্ষুদে বার্তায় রিতা বেগম ও তাঁর পরিবারকে পুড়িয়ে মারার হুমকি দেওয়া হয়। সেই ক্ষুদে বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে রিতা বেগম গত ২৯ এপ্রিল জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষ আলামিন প্রামাণিক, সানোয়ার প্রামানিক ও জলিল প্রামানিকের বিরুদ্ধে নওগাঁ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এই ঘটনার পর দিন গত ৩০ এপ্রিল রাতে রিতা বেগম অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুত্বর আহত হন এবং ১ মে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। অজ্ঞাতনামা মোবাইল নাম্বারের সূত্র ধরে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ মোবাইল নাম্বারটির মালিক সাইফুল ইসলামকে শনাক্ত করেন। পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল ইসলাম দাবি করেন, গত ২৪ এপ্রিল মোবাইলসহ তাঁর নাম্বারটি রাণীনগর উপজেলার ত্রিমোহনী বাজার থেকে হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে পুলিশ তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় মোবাইলটি রিতা বেগমের বাসা থেকে উদ্ধার করে। হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন ও সিমটি উদ্ধারের পর জিজ্ঞাসাবাদে রিতা বেগমের মেয়ে আরিফা খাতুন (১৫) এসএমএস ও রিতা বেগমের মৃত্যুর ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেন। গতকাল বুধবার আরিফা খাতুন স্বেচ্ছায় স্বাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে রিতা বেগমের মৃত্যুর ঘটনার বিবরণ দেন।
১৬৪ ধারায় আরিফার দেওয়া জবানবন্দির উল্লেখ করে পুলিশ সুপার বলেন, আদালতের কাছে আরিফা বলে, তার বাবা গত ২৪ এপ্রিল মোসলেম প্রামানিক মোবাইল ফোনটি ত্রিমোহনী বাজারে পড়ে পায়। ওই মোবাইল ফোনে থাকা সিম ব্যবহার করে তার মা রিতা বেগম ওই দিন রাত সাড়ে ৩টার দিকে নিজেই প্রতিবেশী ময়েনের কাছে এসএমএসটি পাঠান এবং পরবর্তীতে থানায় জিডি করেন। গত ৩০ এপ্রিল রিতা বেগম পরিকল্পনা করেন, রিতা বেগম নিজেই তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবেন। সেই সময় তাঁর স্বামী মোসলেম ও মেয়ে আরিফা চিৎকার করে মানুষ ডাকেন এবং তৎক্ষনাৎ পানি ঢেলে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ এপ্রিল রাতে রিতা বেগম পরনের ম্যাকসিতে আগুন ধরিয়ে দেন। কিন্তু আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং নেভাতে ব্যর্থ হয়। আগুন নেভাতে না পেরে রিতা বেগম আত্মরক্ষাতে বাড়ির পাশে পুকুরে ঝাপ দেন। পরবর্তীতে ওই রাতেই তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে নওগাঁ সদর হাসপাতালে এবং পরে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পর দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
সংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান মিয়া বলেন, হত্যা মামলায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে নিহত রিতা বেগমের স্বামী ও সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে কিনা, সে বিষয়টি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও আইনি বিষয়টি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একেএম মামুন খান চিশতী, আবু সাঈদ ও সুরাইয়া খাতুন, নওগাঁ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।