প্রথমে ফেসবুকে প্রেমের সম্পর্ক এরপর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন বিনোদন স্পটে ঘুরাঘুরি। কৌশলে একাধিকবার হিন্দু তরুণীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক যুবকের। এরপর তরুণী তার প্রেমিককে বিয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করলে সে নানা টালবাহানা শুরু করে। এমনকি বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে দেড় বছর স্বামী-স্ত্রীর মতো দুজনে এক রুমে বসবাস করেন। একপর্যায়ে সব অস্বীকার করে তাকে মুখ না খোলার জন্য নানা রকম ভয়ভীতি ও মামলার হুমকি দেখানো হয়। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায়। প্রতিবেদকের অনুসন্ধানকালে ঘটনা ও দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর ফ্যাশন বিভাগে কর্মরত (ছদ্মনাম) মল্লিকা মলি (৩০) এর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় গহিরা এলাকার আরমানের সাথে।
সেই পরিচয় রূপ নেয় দেখাদেখি আর প্রেমে। ছলে বলে কৌশলে যুবক মলিকে নিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ঘুরে বেড়ান। এক সময় প্রস্তাব দেন বিয়ের। কিন্তু মলি খুলে বলেন তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এমনকি এক সন্তানের জননী। তাঁর পূর্বের স্বামীর সাথে অমিল হওয়ায় ২০১১ সাল থেকে সে পৃথক রয়েছে। কোন রকমে সন্তানকে নিয়ে ফ্যাক্টরীতে চাকরি করে জীবন নির্বাহ করেন।
অপরদিকে, এসব কথা জানার পরও কিছুই বুঝতে রাজি নন আরমান। সে বিয়ে করবেই। এমনকি মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে রাজি করে ফেললেন মল্লিকা মলিকে। গত ২০১৯ সালের ০৬ নভেম্বর হিন্দু ধর্ম থেকে হলফনামা মূলে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে নতুন নাম রাখে মলি ‘নরিন আক্তার’। পরে বাসা ভাড়া নিজে বহন করবে বলে আলাদা বাসা নিতে বলেন মলিকে। মলিও যুবকের মিষ্টি কথায় সরল বিশ্বাসে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এবং আলাদা বাসা নেন বায়েজিদ এলাকায়।
মামলার অভিযোগে আরো লেখা হয়েছে, গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ১১টার সময় বাসায় এসে হাজির হন আরমান। এমনকি ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুখ চেপে তরুণীকে ধর্ষণ করেন। পরে বিভিন্ন লোভ লালসা ও শিগগিরই বিয়ে করবে এমন আশ্বাসে শান্ত করেন মলিকে। এভাবে একাধিবার বিয়ে করে ঘরে তুলে নিবে বলে ঐবাসায় রাত্রিযাপন করত আরমান। স্বামী-স্ত্রীর মতো মেলামেশা করতে থাকেন। ইতোমধ্যে যা আশেপাশের সবাই জেনে গেছে। এসব ঘটনার কিছুদিন পর গত ২ জানুয়ারি রাত ১০টার সময় বিবাহের নিকাহ্ নামা সম্পাদন করবে বলে মলিকে আবারও চন্দ্রঘোনাস্থ লিচু বাগানের মোহাম্মদীয়া এন্টারপ্রাইজের পেছনের একটি কক্ষে নিয়ে যান। সেখানেও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণে মাতেন যুবক।
বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দীর্ঘদিন এভাবে ধর্ষণ করার ফলে গর্ভবতী হন তরুণী। কিন্তু গর্ভের সন্তান না নিতে চাপ দেয় যুবক। দোহায় দেখান এখন সন্তান নিলে বাসায় তুলতে পারবে না। সমাসের লোকজন কি বলবে; এছাড়াও নানা কাহিনী শুনিয়ে সুকৌশলে দমিয়ে রাখেন মলিকে। এক সময় দুজনে নোটারী পাবলিকে ‘যৌথ বিবাহের হলফনামা’ তৈরি করেন। যার কোন তথ্য উপাত্ত পরবর্তীতে সরকারি বালাম ও ভলিয়মে অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি বলে মলি জানান। তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না এসবও প্রতারণামূলক তৈরি করা হয়েছিলো। এরপরও সব সহ্য করে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে বিবাহের নিকাহনামা করতে বললে যুবক কালক্ষেপণ করতে থাকেন। বার বার সময় নেন। একদিন বেশি জুরাজুরি করলে এক পর্যায়ে সব অস্বীকার করে বসে আরমান। যদিও তাদের দুজনের কিছু স্থিরচিত্র দেখে স্পষ্ট বুঝা যায়, দীর্ঘদিন তাঁরা একত্রিত ছিলেন।
অবশেষে ভুক্তভোগি তরুণী কোন উপায়ান্তর না দেখে ধর্ষণের অভিযোগে প্রতারক যুবককে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে (দমন ট্রাইবুনাল-৪ চট্টগ্রাম, বায়েজিদ থানাধীন) মামলা নং-৪০/ ২০২১ দায়ের করেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন চট্টগ্রামস্থ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বিভাগের এসআই মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন। তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে শিগগির জানতে পারব কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। তখন আপনাকে জানাব হয়ত।’ ঐ মামলার এজাহার নামীয় আসামি হলেন মোঃ আরমান (৩০)। যিনি রাউজান থানাধীন পশ্চিম গহিরার রোজা আলী বাড়ির মোঃ ওসমানের ছেলে। তিনি রাঙ্গুনিয়ার লিচু বাগানে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবসা বাণিজ্য করতেন।
অপরদিকে একই ঘটনায়, অভিযুক্ত আরমানকে ফেসবুকে নগ্ন ছবি দিয়ে মলি তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এমন অপরাধে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা নং-১১৭/২০২১ দায়ের করেন। এতে আসামি করা হয় চট্টগ্রাম বায়েজিদ বোস্তামী অক্সিজেন এলাকার জগবন্ধু মল্লিকের মেয়ে মল্লিকা মলিকে (ছদ্মনাম)। যার নিজ বাড়ি রাঙ্গামাটির কাপ্তাই থানাধীন চন্দ্রঘোনার মিলিঙ্গাছড়ি। মামলাটি তদন্ত করছেন রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার এসআই মোঃ মামুন মিয়া। তিনি বলেন, ‘সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় যে অভিযোগ গুলো তোলা হয়েছে যেমন-ফেসবুকে আইডি থেকে বাদিকে নগ্ন ছবি প্রেরণ ও ব্যাংক হতে ২০ হাজার ও আরেক দাগে ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন বিবাদী। সেটা সত্য বলে ব্যাংক স্টেটমেন্ট থেকে জেনেছি। সেই অনুযায়ি তদন্তে যা তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি তা প্রতিবেদনে লিখে আদালতের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মলি বলেন, “আমার সঙ্গে প্রেম ঘটিত সম্পর্ক ছিল। বার বার বিভিন্ন জায়গায় বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ধর্ষণ করেছে। ও আমাকে ভুয়া হলফনামা ধরিয়ে দিয়ে বিয়ে করলেও এখন সব অস্বীকার করে চম্পট দিয়েছে। কিছুদিন স্বামী স্ত্রীর মতো বসবাস করে যা যা করে সব করেছে। এখন এসব নিয়ে উল্টো আমার বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছে।” যদিও আরমান দাবি করেছেন, “এসব মিথ্যা কাহিনী বরং ওকে ফাঁসাতে এসব তৈরি করছেন ওর ঘরের শত্রু।” পাল্টাপাল্টি মামলা ও একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করলেও হিন্দু তরুণী অভিযোগ করে বলেন, “বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে দেড় বছর যাবত স্বামী-স্ত্রীর মতো সংসার করেছেন আরমান। পরে দূরত্ব তৈরি করে। ফলে উপায় না পেয়ে আমি বিচারের দাবিতে আদালতের আশ্রয় নিয়েছি।” মলি পুনরায় বলেন,“আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ধর্মান্তরিত করে কেন বারবার ধর্ষণ করলো আমি এর বিচার চাই। আমার সবকিছু জেনে শুনে কেন আমাকে ধর্মান্তরিত করলেন। হলফনামা মূলে বিয়ে করে আমরা ১৭ মাস ধরে বায়েজীদ এলাকার একটি বাসা ভাড়ায় বসবাস করি। আমি আমার বিয়ের স্বীকৃতি পাইনি। তাই আইনের কাছে বিচার চেয়ে মামলার আশ্রয় নিয়েছি।”
অভিযুক্ত যুবক আরমানের সাথে কথা হলে তিনি জানান ভিন্ন কথা। পাল্টা অভিযোগ তুলে তিনি আমাদের প্রতিবেদককে বলেন, “হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হওয়া তরুণীকে আমি বিয়ে করেছিলাম সেটা সত্য। কিন্তু পরে দু’পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের জ্জ মাস পর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ঐসময় মেয়ের ভাইও ছিলো বৈঠকে। কোন ধরনের জোর জবরদস্তি ছাড়া দুইশত টাকার স্ট্যামে লিখিত ভাবে ছাড়াছাড়ি হয়েছে তাদের।”
আইন আদালত কিংবা কাজী অফিসে ছাড়াছাড়ি না হয়ে কিভাবে স্ট্যামের মাধ্যমে বিয়ে ছাড়াছাড়ি হয় প্রশ্ন করা হলে আরমান বলেন, ‘কিভাবে সেটা দু’পরিবারের সবাই জানে। আমি আদালতে স্ট্যামটি দেখাব। আসলে প্রকৃত ঘটনা হলো অন্যদিকে, কি ঘটনা জানতে চাইলে তিনি জানান, তার এক আপন মামা। নাম যার আলমগীর। ওর কাছ থেকে সে ব্যবসা বাবদে ৪৫ লক্ষ টাকা দেনা পায়। ঔ টাকা চাইতে গেলে আলমগীর ঐ মেয়েকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ভাবে আমাকে হয়রানি করছেন। এটাই প্রকৃত ঘটনা। আর কিছু নয়।”
ধর্ষণের অভিযোগে আজকাল এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, যার নাম বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ। বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ! আইন কি বলে? জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জজ কোর্ট এর আইনজীবী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‘ধর্ষণে যে জোরপূর্বক বা বলপ্রয়োগের বিষয় থাকে তা অনেক সময় অনুপস্থিত। প্রেমের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যখন শারীরিক সম্পর্ক হয় তখন সেটা ধর্ষণ নয়। কিন্তু পরে যখন বিয়ের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না তখন ধর্ষণ মামলা করা হয়। আমার বিচেনায় এটা প্রতারণা। আমার মনে হয় আইনে এটার ব্যাখ্যা এবং আলাদা শাস্তির বিধান থাকা উচিত। কোন নারী বা পুরুষ যাতে অন্যায় করার সুযোগ না পায়।”