মানব সভ্যতার অগ্ৰযাত্রা কখনোই বাঁধা মুক্ত, অবিরাম চলমান কিংবা চির মসৃণ ছিল না। সভ্যতার বিকাশে কতগুলো নিয়ামক শক্তি বিদ্যমান যেগুলো সভ্যতার গতি প্রাবাহকে টেনে ধরেছে প্রতিনিয়ত, থামিয়ে দিতে চেয়েছে এর বিকাশ ও উন্মেষকে । প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী নিয়ামকসমূহের মধ্যে যেমন রয়েছে কিছু প্রাকৃতিক কার্যকারণ , তেমনই রয়েছে কিছু মানবসৃষ্ট প্রভাবক যা সভ্যতার বিনির্মাণের পথে ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালন করেছে। মানবসৃষ্ট যেসকল প্রভাবক সভ্যতার অগ্ৰযাত্রাকে বারবার রুদ্ধ করেছে,তাদের মধ্যে যুদ্ধ অন্যতম অনুঘটক। মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে যেসকল যুদ্ধ ইতিহাসের পট পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভয়াবহ ও আলোচিত যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। এই যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদের চেতনা লালনকারী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী অক্ষ শক্তির প্রতিনিধি জার্মান, জাপান ও ইতালির মতো দেশগুলোর সাথে তথাকথিত উদার গণতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী মিত্র শক্তির প্রতিনিধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোর মধ্যে সংঘটিত মানব ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ও দুঃখজনক ঘটনা। জার্মানির চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও জার্মান শ্রেষ্ঠত্ববাদ তত্ত্বের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের বীজ রোপিত হয়। ক্ষমতা লাভের পরপরই তিনি জার্মানিকে অস্ট্রিয়ার সাথে সংযুক্ত করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। ১৯৩৬ সালের দিকে জাপান ও জার্মানির মধ্যে কমিনটার্ন বিরোধী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৩৭ সালে মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালি ওই চুক্তিতে যোগদান করলে দেশ তিনটির মধ্যে বার্লিন-রোম- টোকিও অক্ষচুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তিটি ছিল ফ্রান্স, ব্রিটেন ও রাশিয়া বিরোধী চুক্তি। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত হিটলার জার্মানিকে অস্ত্রে সুসজ্জিত করেন এবং ইউরোপের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী নাৎসি বাহিনী গঠন করেন। চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার চেকোস্লাভাকিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যার ফলশ্রুতিতে চেকোস্লাভাকিয়ার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় এবং লিথুয়ানিয়ার কাছ থেকে মোমেল বন্দর জোরপূর্বক দখল করে নেন। পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে ডানজিগ বন্দর দখল করে নেন এবং এরফলেই আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্বাভাবিক পরিসমাপ্তি ও পরাজিত পক্ষের উপর চাপিয়ে দেয়া বৈষম্যমূলক বিভিন্ন চুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে। বিশ্বব্যাপী উপনিবেশিক শক্তির বিষবাস্প ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধংদেহী মনোভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য সহায়ক পরিবেশে সৃষ্টি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তির অন্যতম প্রতিনিধি জার্মানির জন্য চাপিয়ে দেয়া ভার্সাই চুক্তি ছিল চরম অপমানজনক। এই চুক্তির ফলে জার্মান সাম্রাজ্য সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ে। সাম্রাজ্যের অন্তর্গত দেশসমূহ হাতছাড়া হয়ে যায়। রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে জার্মানির ব্যপক ক্ষতি সাধিত হয় যা দেশটির মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহার সঞ্চার ঘটে এবং পরবর্তী যুদ্ধ ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে চলমান ঘটনাবহুল এই মহাযুদ্ধ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রানহানি ঘটিয়ে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনিবার্য প্রতিফল। প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা বিশ্বে গণতন্ত্র, শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনমন ঘটে। ভার্সাই চুক্তি গণতন্ত্রের পরিবেশকে দুর্বল করে দেয় এবং সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে গণতন্ত্র, শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের আন্দোলন ত্বরান্বিত হয় যা আরেকটি যুদ্ধের পথকে প্রশমিত করে। গ্ৰেট ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দেশগুলোর মনোভাব জার্মানিকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে। জাপান ও ইতালির মতো পরাশক্তিগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রাধান্য বিস্তার করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিপত্তি অর্জন করা একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়। এরফলে জাপান, জার্মানি ও ইতালির মাঝে মৈত্রী তৈরি হয় এবং যুদ্ধের উন্মাদনায় মেতে উঠে।এসময় সারাবিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতা ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশে দেশে নৈরাজ্যবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। অথচ এই নিরাজ্যবাদ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে মোকাবেলা করতে লীগ অব নেশন ও ব্রিটেন- ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দেশগুলো সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। সাম্রাজ্যবাদী জাপান কর্তৃক ১৯৩১ সালে মানচুরিয়া দখল, ১৯৩৭ সালে ফ্যাসিবাদী ইতালি কতৃক ইথিওপিয়া দখল ও স্পেনের গৃহবিবাদ তৎকালীন পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলে।১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে দেশটিতে উগ্ৰজাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে যার বিষবাষ্প পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলে। ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের স্বৈরাচারী মনোভাব বা সর্বাত্মকবাদ (Totalitarianism) গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। তারা গণতন্ত্র ধ্বংস করে সামরিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কামনায় সম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হয় যার ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সময় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি এবং এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ক্ষতির চেয়ে পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ ছিল আরো ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। বিশ্ববাসী এই যুদ্ধে প্রথমবারের মতো পত্যক্ষ করেছিল পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা যার প্রভাব এখনো জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বিদ্যমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপীয় সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবের কারণে সমাজতন্ত্র বিকাশ লাভ করে এবং পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পূঁজিবাদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত হয়। পশ্চিম জার্মানিতে ও পূর্ব জার্মানিতে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। গোটা বিশ্ব ব্যবস্থা পূঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র- এই দুই প্রধান ব্লকে বিভক্ত হয়ে পড়ে যা তৎকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা করে। ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদী রাজনৈতিক দল সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অর্জন যা আদ্যবধি টিকে আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা মানব ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বর্তমান সময়ে বিশ্বের অনেক দেশের হাতেই আনুবিক অস্রের মজুদ রয়েছে এবং অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বিশ্বব্যাপী অস্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ক্ষুদ্র পরিসরে যুদ্ধ চলমান থাকলেও তা কখনোই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ লাভ করেনি। জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিভিন্ন যুদ্ধবিরোধী সংগঠন বৃহৎ পরিসরে যুদ্ধ এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে পৃথিবীকে যুদ্ধের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব জাগ্ৰত হওয়া আশু প্রয়োজন। রাজনৈতিক মহলে শুভবুদ্ধির উদয় হলেই মানব সভ্যতা যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবী হয়ে উঠবে সবার জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
লেখক- আকতারুল ইসলাম