প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষাকে বহুমাত্রিক করতে কাজ করছে তার সরকার। তিনি বলেন, টেক্সটাইল, ডিজিটাল, প্রতিটি বিভাগে একটি করে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছি। ফ্যাশন ডিজাইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে আধুনিক যুগে কী কী ধরনের বিষয় লাগে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছি।’
গতকাল রবিবার সকালে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপবৃত্তি, টিউশন ফি, ভর্তি সহায়তা ও চিকিৎসা অনুদান বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ সচিবালয়ের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে এদিন ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮২ শিক্ষার্থীকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে উপবৃত্তি, টিউশন ফি, ভর্তি সহায়তা ও চিকিৎসা অনুদান বিতরণ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় করেছি; অর্থাৎ বিষয় নির্বাচন করে যেসব এলাকায় যে ধরনের শিক্ষার গুরুত্ব বেশি, সেভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করে দিচ্ছি। যাতে সবাই শিক্ষাটা যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষাটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এটা দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।’
করেনার কারণে দেশের সব স্কুল, কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ থাকার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করছি- আগামী ৩০ মার্চ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সক্ষম হব। করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মচারী যারা রয়েছেন- সবাইকেই টিকা নিতে হবে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনে কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকেও টিকা দেওয়া হবে।
উপবৃত্তি প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ করে সরকারপ্রধান জানান, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৫ কোটি ৮৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বাবদ বিতরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, কারিগরি শিক্ষার প্রসারে প্রতিটি উপজেলায় ১টি করে টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপন করা হচ্ছে এবং প্রতিটি বিভাগীয় সদরে ১টি করে মহিলা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপন করা হচ্ছে। প্রতি জেলায় একটি করে সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে ।
শিক্ষা সম্প্রসারণে আওয়ামী লীগ সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, বর্তমানে শিক্ষার হার ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার সব জেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছে, যেন ছেলেমেয়েরা ঘরের খেয়ে বাবা-মায়ের চোখের সামনে থেকে পড়ালেখা করতে পারে। তিনি বলেন, প্রাথমিকসহ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ছাত্রছাত্রী উভয়ের জন্য বর্ধিত হারে উপবৃত্তি প্রদান করে যাচ্ছে। ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লিঙ্গ সমতা অর্জন করায় বাংলাদেশ বিশ্বে প্রশংসা অর্জন করেছে।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে আমি একটু বলতে চাই। দেখা যাচ্ছে যে, মেয়েদের সংখ্যাই বেশি এবং ছেলেদের সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে। সেটা যেন না হয় সেদিকে একটু নজর দেবেন। কারণ আমাদের লিঙ্গ সমতাটা একটু অন্য ধরনের হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা কেন কমে যাচ্ছে, সে বিষয়টা একটু দেখা দরকার। আমি মনে করি অভিভাবক, শিক্ষক সবাইকেই এটা দেখতে হবে।’
অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বক্তৃতা করেন। সঞ্চালনা করেন পিএমও সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। অনুষ্ঠানে পটুয়াখালীর গলাচিপা, সুনামগঞ্জের বিশ্বম্বরপুর উপজেলা এবং বান্দরবান সদর উপজেলা সংযুক্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রী পরে উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে তার সরকারের সাফল্য প্রসঙ্গে বলেন, ’৯৬ সালে সরকারে আসার পর তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ‘নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ শীর্ষক’ একটি প্রকল্প হাতে নেয়। তিনি বলেন, সেখানে আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক, মসজিদ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানভিত্তিক এবং বয়স্ক শিক্ষার ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন এনজিওসহ বিভিন্ন সংগঠনকে কাজে লাগানো হয় বয়স্ক শিক্ষার জন্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে আমাদের লক্ষ্য ছিল প্রতিটি জেলাকে নিরক্ষরতামুক্ত ঘোষণা করা এবং এর ফলও পেতে শুরু করে। সবার উদ্যোগে সবার সহযোগিতায় খুব অল্প সময়েই কয়েকটি জেলাকে নিরক্ষরতামুক্ত ঘোষণা করা সম্ভব হয়। সে জন্য সে সময় ইউনিসেফ থেকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার বাবদ প্রায় ১০ হাজার ডলার প্রাপ্তি এবং সেটি দিয়ে একটি বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। ৪৫ থেকে শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশে উন্নীত করি। তবে পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সেটি বন্ধ করে দেয়। সে সময় পিএইচডি বা উচ্চ শিক্ষার্থে যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে গমন করে, তাদের কোর্স কারিকুলাম বাদ রেখেই দেশে ফিরিয়ে আনে।
এ ধরনের সরকারি কর্মসূচিগুলো যেন বন্ধ হতে না পারে- সে জন্য আওয়ামী লীগ সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সে জন্য যাই করি- সব সময় এটা চিন্তা করি যে, সরকার বদল হলেও যেন এগুলো বন্ধ না হয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত ৩৩৭টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৩৩৯টি বেসরকারি কলেজ সরকারিকরণ করেছে। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তায় উন্নীত করেছে এবং ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছে। এতে ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ হয়।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, করোনাকালীন সময়েও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫ হাজার ৩৫১ শিক্ষক-কর্মচারীকে ৫১৭ কোটি ৩৩ লাখ ১২ হাজার টাকা অবসর সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ৫ হাজার ৪৪৬ শিক্ষক-কর্মচারীর কল্যাণ ভাতার আবেদন নিষ্পত্তি করে ২১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৮ হাজার ১৩৫ টাকা প্রদান করা হয়েছে।