ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা একুশে পদকপ্রাপ্ত গণসঙ্গীত শিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর-এর ৭১তম জন্মবার্ষিকী সোমবার ব্যাতিক্রম ‘আনন্দ আয়োজনের’ মধ্য দিয়ে গাজীপুরের মনিপুর বিশিয়া কুড়িবাড়ি এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র (বৃদ্ধাশ্রম) চত্ত্বরে পালন করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে বৃদ্ধাশ্রমে নিবাসীদের অংশ গ্রহণে কেক কেটে ও গান গেয়ে আনন্দ উল্লাস করা হয়। গুণী শিল্পীদের কাছে পেয়ে কেন্দ্রের বাসিন্দারা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেন। অনুষ্ঠানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমানসহ দেশের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী ও বৃদ্ধাশ্রমের নিবাসীরা অংশ নেন।
সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে গণসঙ্গীত শিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীরের ৭১তম জন্ম দিনের কেক কাটা হয়। এ সময় ফুল দিয়ে আগতরা ফকির আলমগীরকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং গিভেন্সী গ্রুপ অব ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি লেখক ও গবেষক গোলাম কুদ্দুছ, একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেত্রী সালমা বেগম সুজাতা (সুজাতা আজিম), একুশে পদকপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পী মোঃ খুরশিদ আলম, পল্লীমা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়না, গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লা আল জাকী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল শেখ, খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুলের স্ত্রী মাসুমা খাতুন নিপা প্রমুখ। অনুষ্ঠানে ফকির আলমগীরের স্ত্রী সুরাইয়া আলমগীর ও নাতি ফকির ফারদিন আলমগীরসহ ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।
গণসঙ্গীত শিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘যাদের জীবন অবহেলিত, বিপন্ন। অবশ্য তবাৎ দুনিয়াই আজ কোভিড-১৯ এ বিপন্ন, বিষন্ন। যারা একাকীত্ব বোধ করেন, নিরানন্দ বোধ করেন। আমি গতবারই জাতীয় যাদুঘরে যখন ৭০ তম জন্মদিনে করেছিলাম, তখন বলেছিল- আধুনিক, চাকচিক্য আলোকউজ্জল পরিবেশে আর আমার জন্মদিন পালন করব না। যত দিন বেঁচে থাকব কখনো বৃদ্ধাশ্রম, কখনো পথশিশু, কুলি, মজুর তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রতিবছর জন্মদিনের আনন্দ ভাগাভাগি করে পালন করব।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আমাদের মতো শিল্পীদের জন্ম হতো না। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ পেতাম না। তাঁর জন্ম শত বার্ষিকী চলছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার জন্ম দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম।’
এসময় তিনি বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে, কেক কেটে এবং বয়স্ক পূনর্বাসনের নিবাসীদের মাঝে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে তাদের দেশ প্রেম সমুন্নত রাখতে উপস্থিত সকলকে আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠাণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মোঃ এনামুর রহমান এমপি বলেন, ফকির আলমগীর দেশকে ভালবেসে গান গেয়েছেন, এখনও গাইছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার গাওয়া গাণ স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হতো। তার গাওয়া গণসঙ্গীত, রণসঙ্গীত দেশের মানুষকে, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বেলিত করতো, সাহস ও শক্তি যোগাত। আমি তার শতায়ু কামনা করি।
অনুষ্ঠাণের দ্বিতীয় পর্বে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান হয়। এতে কণ্ঠ শিল্পী ফকির আলমগীর, খুরশীদ আলমসহ ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী ও বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সদস্যরা সংগীত পরিবেশন করেন এবং কেন্দ্রের বাসিন্দাদের আনন্দ দেন।
এর আগে ফকির আলমগীরসহ অতিথিরা বৃদ্ধাশ্রম ক্যাম্পাসে উচ্চ ফলনশীল আম গাছের চারা রেপন করেন। এসময় বৃদ্ধাশ্রমের নিবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন ও তাঁদের খোঁজখবর নেন ফকির আলমগীর।
ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম মৌঃ হাচেন উদ্দিন ফকির, মাতার নাম বেগম হাবিবুন্নেসা। শিল্পী কালামূধা গোবিন্দ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংবাদিকাতায় এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। গণসঙ্গীতে নিবেদিত এ শিল্পী ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে এবং ‘৬৯-এর গণঅভ্যুথানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শিল্প একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশনার পাশাপাশি প্রচলিত ও প্রথাসিদ্ধ গানের বন্ধ্যাভূমিতে দেশজ ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা গানে নতুন মাত্র সংযোজন করেন। সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য তাকে করে তোলে আরো প্রতিশ্রুতিশীল, গণমুখী ও জনপ্রিয়। একজন সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে সফলতার সঙ্গে তুলে ধরেন। সঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর একজন সফল কলামিস্ট ও লেখক। চিরসবুজ এই কণ্ঠশিল্পী সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক, শেরে বাংলা পদক, ‘ভাসানী পদক, সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব অনার’, তর্কবাগিশ স্বর্ণপদক’, জসীম উদ্দীন স্বর্ণপদক, কান্তকবি পদক’, ‘গণনাট্য পুরস্কার’, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মহাসম্মাননা’, ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় পুরস্কার, ‘ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড যুক্তরাষ্ট্র’, ‘জনসংযোগ সমিতি বিশেষ সম্মাননা’, ‘চ্যানেল আই মিউজিক এ্যাওয়ার্ড বিশেষ সম্মাননা ও বাংলা একাডেমি সম্মান সূচক ফেলোশিপ’।
ফকির আলমগীর ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি, জনসংযােগ সমিতির সদস্য, বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাপামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কমিটির সদস্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিষদের সদস্য, পল্লীমা সংসদের আজীবন সদস্য এবং অফিসার্স ক্লাবের সম্মানিত সদস্য।
শিল্পী ফকির আলমগীর পেশায় বিসিআইসি’র জনসংযোগ বিভাগের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত। স্ত্রী সুরাইয়া আলমগীর, তিন পুত্র সন্তান রানা, রাজীব ও রাহুল। ২০১৯ সালে তিনি পবিত্র হজ্জব্রত পালন করেন।