দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে আমরা সকলেই এক জন স্বাধীনতা সংগ্ৰামী,রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী হিসাবে চিনি।এসবের পরও তিনি যে এক জন কবি তা আমরা কজনই বা জানি ?তিনি তাঁর ঐক্য, অসাম্প্রদায়িকতা, দেশপ্রেম, ত্যাগ ও নিবেদিত প্রাণের জন্য দেশবাসীর কাছে দেশবন্ধু হিসাবে পরিচিত।কিন্তু তিনি যে বাংলা সাহিত্যের এক জন একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন তা সবার আড়ালে চলে যাচ্ছে।তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর কবি পরিচয়।
দেশবাসীর কাছে যিনি রাজনীতিবিদ হিসাবে পরিচিত তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল মাত্র ছয়-সাত বছরের।এত অল্প সময়ের রাজনৈতিক জীবনে তিনি যেভাবে সারা দেশে প্রভাব ফেলে দিয়েছিলেন তা তাঁর আগের অন্য কোন নেতার পক্ষে সম্ভব হয়নি।আর সর্বভারতীয় স্থরে এখন পর্যন্ত কোন নেতার পক্ষে এমন প্রভাব ফেলা সম্ভব হয়নি।তিনি ছিলেন জাত-বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধে।তিনি নারী মুক্তি,নারী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহের পক্ষে ছিলেন।এ সব কিছুর জন্য তাঁর স্বপ্লকালীন রাজনৈতিক জীবনই তাঁর জীবনের অন্য সব পরিচয় আড়াল করে দিয়েছে।
এই মহান দেশ প্রেমিকের জন্ম হয়েছিল ১৮৭০ সালের ৫ নভেম্বর কলকাতার এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে।তাঁর পিতা ভুবন মোহন দাস ছিলেন কলকাতা হাইকার্টের এক জন সলিমিটার ।তাঁর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কলকাতাতেই।কলকাতার মহাবিদ্যালয় থেকেই তিনি বি.এ পাশ করেন।তারপরে লণ্ডনে চলে যান আইন বিষয়ে উচ্চ ডিগ্ৰীর জন্য।এখান থেকে ফিরে এসে তিনি আইনজীবী হিসাবে কর্ম জীবন শুরু করেন।যদিও তিনি পেশায় আইনজীবী ছিলেন তবু সাহিত্য অনুরাগটা কোন দিনও তাঁর মন থেকে হারিয়ে যায়নি। তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু সেই ছোটবেলে থেকেই।দেশ যখন পরাধীন,দেশবাসী যখন ইংরেজদের কাছে অত্যাচারিত,নিপীড়িত তখন তিনি কলম ধরেছিলেন।তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে অত্যাচারিত ,নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের কথা।বাংলা মা ও মাটির কথা সুন্দর ভাবে ফোটে উঠেছে তাঁর কবিতায়।তাঁর লেখা কাব্যগ্ৰন্থ পাঁটটি ।তাছাড়া তিনি “নারায়ণ” নামক একটি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন।তাঁর লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় “নব্যভারত” পত্রিকায়।তাছাড়াও তাঁর লেখা প্রকাশিত হত “নির্মাল্য” ও “মানসী” নামক পত্রিকাতেও।তাঁর লেখা প্রথম কবিতা “বন্দী”।তাঁর প্রথম কাব্য গ্ৰন্থ “মালঞ্চ”১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয়।তারপর একে একে দ্বিতীয় কাব্য গ্ৰন্থের নাম “মালা”, তৃতীয় কাব্য গ্ৰন্থ “সাগর সঙ্গীত” ১৯১১ সালে প্রকাশিত হয় তারপর ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয় চতুর্থ কাব্যগ্ৰন্থ “অন্তর্যামী” এবং সবশেষে।তাঁর পঞ্চম তথা শেষ কাব্যগ্ৰন্থ “কিশোর কিশোরীতে” প্রকাশিত হয়।
তিনি সাহিত্যকে কতটা ভালোবাসতেন তার প্রমাণ পাওয়া যার তাঁর নিজের বক্তৃতাতেই।পাটনা সাহিত্য পরিষদ আযোজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি নিজেই বলেছিলেন “আমিও সাহিত্য সেবেয় জীবনাতিবাহিত করিব বলিয়া ঠিক করিয়াছিলাম,ঘটনাচক্রে এক্ষেত্রে আসিয়া পড়িয়াছি।নতুবা সেই পথই অবলম্বিত হইত।” তিনি চেয়ে ছিলেন সারা জীবন ধরে সাহিত্য সাধনা করতে কিন্তু দেশের পরাধীনতা তাঁর জীবনের চলার পথ বদলে দেয়।এ জন্য তাঁর আক্ষেপও ছিল।১৯২৫ সালের ১৬ জুন বিক্রমপুর-মুন্সিগঞ্জ সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করে দার্জিলিংয়ে আকস্মিক ভাবে তাঁর মৃত্যু ঘটে।তাঁর মৃত্যুতে শোকে ভঙ্গে পড়েছিল তাঁর অনুরাগী সকল।শোকে ভেঙ্গে নজরুল ইসলাম লিখে ছিলেন “রাজভিখারী” কবিতা।শোকার্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখেছিলেন ,”এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করেগেলে দান।” এই পংক্তি দুটি।তাছাড়া জীবনানন্দ দাস লিখেছিলেন”দেশবন্ধুর প্রয়াণে” নামক কবিতা।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নিঃসন্ধেহে একজন দেশ প্রেমিক,বিখ্যাত আইনজীবী,রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্ৰামী ছিলেন।তাঁর দেশপ্রেম ,দান,বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িকতার বার্তার জন্য তিনি দেশবাসীর কাছে স্মরণীয় ও প্রণম্য হয়ে আছেন।তা যথার্থ কিন্তু তিনি যে বাংলা সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন তা ভুলে গেলে চলবে না।চিত্তরঞ্জন দাস বাংলা সাহিত্যের এক জন কবি।বাংলা সাহিত্যে রয়েছে তাঁর বিশেষ অবদান।নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁই কবি পরিচয় তুলে ধরা অতি প্রয়োজন।
বিপ্লব গোস্বামী