সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে শংঙ্কা আর সংঘাতের আশংকার মধ্যে দিয়ে জমে উঠেছে শতবছরের পুরাতন ঐতিহ্যবাহি পাবনা পৌরসভার নির্বাচন। আগামী ৩০ জানুয়ারী শনিবার এই পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে ৫ জন মেয়র প্রার্থী ও সাধারন কাউন্সিল ৭৪ এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ১৭ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে আওয়ামী লীগ বনাম নৌকা প্রার্থীর মধ্যে। কে হচ্ছেন, পৌর মেয়র এই নিয়েই চলছে পুরো শহর জুড়ে নানা গুঞ্জন। ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দলের অঙ্গণে এই অশনি সংকেত নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছে দলের নেতা-কর্মি ও সমর্থকরা। চলছে আওয়ামীলীগ প্রার্থী ও নৌকা প্রার্থীর পরস্পর বিরোধী বক্তব্য। নির্বাচনী মাঠের হালচিত্রে অস্বস্থি আর দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছেন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীলীগ সমর্থক সাধারন মানুষ। অস্বস্থির জায়গা তৈরী হয়েছে কাকে ভোট দেবেন পৌরবাসী ‘‘আওয়ামীলীগ প্রার্থীকে’’ না ‘‘নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে’’। ভোটের আর মাত্র তিনদিন বাকীঁ। এই অমিমাংসিত দ্বন্দে¦ দিন পার হচ্ছে পৌরবাসীর।

কাকডাকা ভোর থেকেই প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থীর সমর্থকরা। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন, চাইছেন ভোট আর দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি তারা। পুরো জেলার দৃষ্টি যেন পড়েছে পাবনা সদর পৌরসভার নির্বাচনে। তবে উৎসবমূখর পরিবেশে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা জমে উঠেছে। পাড়া, মহল্লায় প্রচারযন্ত্র, নির্বাচনী অফিস, পোস্টারিং, ছোট ছোট প্যানা সাইনে অলিগলি আর আঞ্চলিক সড়কগুলোর দু‘পাশের টাঙানো পোস্টারে আকাশ ঢেকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পোস্টারে সাজে সেঝেছে পুরো শহর।
নির্বাচন অফিস সুত্রে জানা যায় আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে মেয়রপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৫ জন। আর সাধারন কাউন্সিল ৭৪ এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ১৭ মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীকের মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে পৌর, সদর ও জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা-কর্মি অবস্থান নেয়ায় প্রতিযোগিতা মূলক নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সরব এখন পাবনা শহর।

১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত পাবনা পৌরসভা। ১৫টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এ পৌরসভায় মোট ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজার ২৪৪ জন। ৩৯টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। অতি সম্প্রতি জেলা যুবলীগরে আহবায়কের পোষ্ট পেয়ে নৌকা প্রতীক অর্জন করেছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলী মূর্তর্জা বিশ্বাস সনি। তাঁর এই নৌকা প্রতীক প্রাপ্তি মেনে নিতে পারেননি স্থানীয় আওয়ামী লীগ। বিরোধ এখানেই শুরু। দলের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
দলের দূর্সময়ে পরীক্ষিত নেতা জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি শরীফ উদ্দিন প্রধান দলের মনোনয়ন না পেয়ে সতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নারিকেল গাছ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়াও জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নুর মোহাম্মদ মাসুম বগা (ধানের শীষ), জাতীয় পার্টির রাজন ইসলাম (লাঙল মার্কা) ও বাংলাদেশ ইসলামী শাসনতন্ত্র’র আবু বকর সিদ্দিকী (হাতপাখা) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মেয়র পদে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আলী মূর্তজা বিশ্বাস সনিকে বর্তমান মেয়র বিএনপি থেকে সদ্য আওয়ামীলীগে যোগদানকারী কামরুল হাসান মিন্টু (ছাত্রলীগের এক সময়ের তুখোড় নেতা, পরে বিএনপিতে যোগদান করেন) ও সমর্থকরাসহ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও যুবলীগের বর্তমান কমিটির যুগ্ম আহবায়ক শিবলী সাদিক, স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি-সম্পাদক ও দলের একাংশের কতিপয় নেতা-কর্মি তাকে সমর্থন করে নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে কাজ করছেন। পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির নেতৃবৃন্দ আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আলী মুর্তজা বিশ্বাস সনিকে সমর্থন জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী সংগঠনের এই নেতৃবৃন্দরা পৌর এলাকার সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নৌকা প্রতীকের পক্ষে ভোট প্রার্থনা করছেন।
অপরদিকে জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি শরীফ উদ্দিন প্রধানের নারিকেল গাছ প্রতীকের পক্ষে কাজ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কিছু নেতা-কর্মি, সদর ও পৌর আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মিরা। এছাড়াও শরীফ উদ্দিন প্রধানের সমর্থনে বামদলের নেতা-কর্মি, সাংস্কৃতিক কর্মি, ব্যবসায়ীরা নাগরিক মঞ্চ নামে একটি কমিটি গঠন করে নির্বাচনী কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছেন।

পৌর এলাকার আব্দুল হামিদ সড়ক, বড় বাজার, অনন্ত মোড়, লাইব্রেরি বাজার, কলেজ গেট, , শালগাড়িয়া, রাধানগর, সিংগা বাইপাস, সোনাপট্টি, কসাইপট্টি, কৃষ্ণপুর, আটুয়া, আরিফপুর, পৈলানপুর, চকছাতিয়ানি, কাঁলাচাদপাড়া, জেলাপাড়া, কোটচত্বর, মাসুমবাজার, বালিয়াহালট, নুরপুরসহ বেশ কয়েকটি মহল্লা ঘুরে দেখা যায়, প্রার্থীরা বাড়িবাড়ি, দোকানপাট, বাজার, শপিংমলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন। এসময় তারা এলাকার উন্নয়নে আগামি দিনের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিও দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রার্থীর কর্মি সমর্থকেরা হ্যান্ড মাইকে প্রচারসহ সভা সমাবেশ অব্যাহত রেখেছেন।

সচেতন ভোটাররা বলছেন, নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আলী মুর্তজা বিশ্বাস সনির সাথে মূলত নারিকেল গাছ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ উদ্দিন প্রধানের ভোট যুদ্ধ হবে আগামী ৩০ জানুয়ারী। ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী নুর মোহাম্মদ মাসুম বগাও বসে নেই প্রচার-প্রচারণায়। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আলী মুর্তজা বিশ্বাস সনি বলছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতীক নৌকা। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি জননেত্রী শেখ হাসিনার দেয়া প্রতীককে কখনও মাথা নিচু করতে দেবে না। দলীয় নেতাকর্মি ও সমর্থকদের পাশাপাশি সচেতন ভোটার পাবনা পৌরসভার উন্নয়নে এবং নাগরিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতে অবশ্যই নৌকা প্রতীককে তাদের মূল্যবান ভোট দিয়ে জয়ী করবেন। তিনি পাবনা পৌরসভাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী পৌরসভায় পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
জনশ্রুতি রয়েছে দলের মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েই পাবনা জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি শরীফ উদ্দিন প্রধান মেয়র পদে নির্বাচন করছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে শরীফ উদ্দিন প্রধান বলেন, জনগন এবং দলের জোড়ালো দাবীতেই আমি প্রার্থী হয়েছি। পাবনার আপামর নাগরিক সমাজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে যারা বিশ্বাস করেন তারাই আমাকে মেয়র হিসেবে দেখতে চান। পাবনার সকল স্তরের নেতাকর্মি আমার সাথে আছেন, তারা মাঠে ময়দানে আমার পক্ষে কাজ করছেন। আমি পাবনার মানুষের পাশে আছি, থাকবো। মেয়র নির্বাচিত হলে অবশ্যই পৌরবাসীর নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমি। তাঁর পকে নাগরিক মঞ্চ এক সংবাদ সম্মেলন করে ২২ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। ২৬ জানুয়ারী নাগরিক মঞ্চের আহবায়ক ইদ্রিস আলী বিশ্বাসের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব কমরেড জাকির হোসেনের পরিচালনায় শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য ও নির্বাচনী ইসতেহার ঘোষনা করেন নাগরিক মঞ্চ সমর্থনপুষ্ট মেয়র প্রার্থী শরীফ উদ্দিন প্রধান।

ঘোষিত ইসতেহারে তিনি উল্লেখ করেন, পৌরকর বৃদ্ধি না করা, মশক নিধন, রাস্তা প্রশস্তকরণ, আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পাবনা টাউন হল সবার জন্য উন্মুক্ত, সর্বোচ্চ ভাড়া ১ হাজার টাকা, পৌরসভার বেদখল সম্পত্তি উদ্ধার, পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট স্থাপন, অন্নদাগোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, রাইফেল ক্লাব, বনমালী শিল্পকলা একাডেমী সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, সকল রাস্তা ও আবাসিক এলাকায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, ভূমিদস্যুর কবলে থাকা নাগরিকদের সহযোগিতা ও প্রতিরোধ, প্রধান সড়কের যানজট নিরসন, ডিভাইডার নির্মাণ, মসজিদ, মন্দির সংস্কার, আরিফপুর, বালিয়াহালট, শালগাড়িয়া ও চকছাতিয়ানী গোরস্থানের সৌন্দর্যবৃদ্ধি ও উন্নয়ন, পৌর এলাকার সকল ঈদগাঁ, মন্দির ও শশ্মানের উন্নয়ন, পৌরএলাকার ১৫ ওয়ার্ডের পঞ্চায়েত গঠন করে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী ও মাদক নির্মূলের ব্যবস্থা, আধুনিক বিনোদন কেন্দ্র ও শিশুপার্ক নির্মাণ, বন্ধন কমিউনিটি সেন্টার পুনঃনির্মাণ করে আধুনিকায়ন করা, পৌরসভার সকল টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সকল ঠিকাদারের অংশগ্রহণ ও পৌরএলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহে অগ্রণী ভূমিকা থাকবে।
ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী নুর মোহাম্মদ মাসুম বগা বলেন, বিএনপির আন্দোলনের অংশ হিসেবেই এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হয়েছে। আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারপরও যদি ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে স্বতঃর্স্ফূতভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, তাহলে শতভাগ বিজয় নিশ্চিত বলে তিনি দাবী করেন। তিনি বলেন, আমি নির্বাচিত হলে পাবনা পৌরসভাকে আধুনিকায়ন করবো। জাতীয় পার্টির রাজন ইসলাম (লাঙল মার্কা) ও বাংলাদেশ ইসলামী শাসনতন্ত্র’র আবু বকর সিদ্দিকী (হাতপাখা) নির্বাচনে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

নির্বাচন নিয়ে জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার মাহবুবুর রহমান বলেন, ছোট খাটো অভিযোগ রয়েছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কোন ধরণের অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না। নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটরা মাঠে রয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।